ডালু উপজাতির পরিচিতি - Introduction to Dalu tribe
ডালু বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ডালুরা ইন্দো-মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর একটি শাখা। এরা নিজেদেরকে মহাভারতের তৃতীয় পান্ডব অর্জুনের পুত্র বভ্রুবাহনের বংশধর বলে মনে করে। কিংবদন্তি আছে যে, বভ্রুবাহনের বংশধর সুবলা সিং বা ডাল্জী মনিপুর হতে বিতাড়িত হয়ে স্বীয় দলবলসহ আসামের পুরো মধ্যাঞ্চল এবং দুর্গম গারো পাহাড় অতিক্রম করে বর্তমান বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভোগাই নদীর তীরে বারেঙ্গাপাড়া নামক স্থানে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। যে স্থানটিতে ডাল্জী সদলবলে বসতি স্থাপন করেন সেই স্থানটি পরবর্তীকালে তাঁর নামানুসারে ডালুকিল্লা নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে স্থানটি ডালুবাজার নামে পরিচিত। পরে এই ডালুবাজার বা ডালুগাঁওকে কেন্দ্র করেই উত্তরে হাড়িগাঁও হতে দক্ষিণে হাতিপাগাড়, কুমারগাতী, সংড়া, জুগলী প্রভৃতি স্থানে এবং কংশ নদীর পাড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ডালুদের বসতি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে বর্তমান ডালু জনসংখ্যা দেড়হাজারের মত এবং তারা বিক্ষিপ্তভাবে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এবং শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায় বসবাস করছে।
জীবিকা
ডালুরা মূলত কৃষিজীবী। তবে বর্তমানে এদের শতকরা নববই ভাগই ভূমিহীন; তাই কৃষিজীবী এ সম্প্রদায় বর্তমানে ভূমিহীন শ্রমজীবী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। ডালু সমাজে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম, মাত্র ১০%। শিক্ষিত ডালুদের অনেকে ইদানীং সরকারি-বেসরকারি চাকুরিও করছে। ডালুরা স্বভাবে শান্ত প্রকৃতির এবং সুশৃংখল জীবন যাপন করতে তারা অভ্যস্ত।
পোশাক-পরিচ্ছদ
ডালুদের পরিধেয় পোশাকপরিচ্ছদ হাজং ও বানাইদের মত। ডালু মহিলারা যে পোশাক পরিধান করে সেটিকে তাদের ভাষায় পাথানি বলে। এই পাথানি দৈর্ঘ্যে ৬৩ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ৪৫ ইঞ্চির মত হয়ে থাকে। ডালু মহিলারা আগে নিজেরাই নিজেদের পাথানি বুনতেন। বর্তমানে তারা বাঙালিদের মত শাড়ি পরিধানে অভ্যস্ত হচ্ছে। ডালু পুরুষেরা ধুতি-জামা ব্যবহার করে থাকে।
ভাষা
ডালুদের মৌখিক এবং লিখিত ভাষা বাংলা। বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণেও তারা বাংলা ভাষাকেই ব্যবহার করে, তবে উচ্চারণগত সামান্য পার্থক্য রয়েছে। এক সময় মণিপুরী ভাষায় ডালুরা কথা বলতো। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশি ডালুরা সেই ভাষা আর ব্যবহার করে না।
খাদ্য
ডালুদের প্রধান খাদ্য ভাত। তরকারি রান্নার বিশেষত্ব প্রায় ক্ষেত্রেই গারোদের অনুরূপ। হিঁদল শুঁটকি তাদের তরকারি রান্নার অন্যতম উপকরণ। বাঁশের কোঁড়, কলার মোচা তাদের নিকট অত্যন্ত প্রিয়। এরা সকল প্রজাতির মাছ, শূকর, ছাগল, ভেড়া, হাঁস প্রভৃতির মাংস খায়। গরু ও মহিষের মাংসকে তারা নিষিদ্ধ মনে করে। নিজগৃহে প্রস্ত্ততকৃত ভাতের পঁচুই মদ ডালুরা পান করতে পছন্দ করে।
গোত্র
ডালুরা কয়েকটি গোত্র বা দলে বিভক্ত। চিকাং, পিড়া এবং মাশী এই তিনটি হচ্ছে ডালুদের প্রধান গোত্র এবং তারা এগুলিকে দপ্ফা বলে। এই তিনটি প্রধান দপ্ফা ছাড়াও ডালুদের আরও সাতটি অপ্রধান গোত্র বা দপ্ফা রয়েছে। সেগুলি হলো: দরুং, নেংমা, কাড়া, মাইবাড়া, বাপার, কনা এবং গান্ধী। এই দপ্ফা বা গোত্রের প্রধান কাজ হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। আন্তঃগোত্র বিবাহ ডালুসমাজে নিষিদ্ধ। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম করে তবে তার জন্য কঠোর সামাজিক শাস্তির বিধান রয়েছে। মাতৃসূত্রীয় সমাজ না হলেও ডালুরা মায়ের দপ্ফা বা গোত্রনাম গ্রহণ করে। সম্প্রতি ডালুরা তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দপ্ফা নামের পরিবর্তে বর্ণহিন্দুদের অনুকরণে গোত্রনাম ব্যবহারে উৎসাহী হচ্ছে।
ধর্ম
ডালুরা হিন্দু সনাতন ধর্মের অনুসারী। তাদের উপাস্য দেবদেবীর মধ্যে গৌর, নিতাই, মনসা প্রভৃতি প্রধান। আদি দেবতা, যেমন- কেড়েং-কুড়ি, পথ-খাওরি, হয়দৈব প্রভৃতির নাম হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ডালুরা বাস্ত্তদেবতার থান রাখে। বাস্ত্তদেবতাকে তারা গ্রামের রক্ষাকর্তা হিসাবে গণ্য করে। প্রায় প্রতিটি বসত বাটিতেই তুলসী মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় যেখানে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ডালু নারীরা শুভ সন্ধ্যাকে আবাহন করে নেয়।
ডালুদের রীতিনীতি
ডালুদের বেশভুষা, আচার ব্যবহার, রীতিনীতি এবং সামাজিক ক্রিয়া প্রায় ক্ষেত্রেই হাজংদের মতোই। বৃটিশবিরোধী কৃষক আন্দোলনে শেরপুর পরগনার বীর অধিনায়ক টিপু পাগলা ডালুদের পূর্ব পুরুষ বলে অনেকেই মনে করেন।
এখনও ডালুদের মধ্যে পাগলপন্থী অনেকের দেখা পাওয়া যায় । এই পাগলপন্থীরা একেশ্বরবাদী এবং পৌত্তলিকাবিরোধী। পাগলপন্থী ডালুরা জটাধারী এবং দাঁড়িগোঁফ রাখেন। গলায় মোটা ধরনের সাদা, কালো এবং নীল রংয়ের পুঁতির মালা পরিধান করে থাকে। ডালুদের বিবাহ হিন্দুদের মতোই। আদিবাসী কল্যণ সমিতি সূত্রে জানা যায়, আগেকার দিনে ডালু মহিলারা শাঁখা সিদুর ব্যবহার না করলেও এখন করেন।