দিয়েগো মারাদোনা এর জীবনী - Biography of Diego Maradona
দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা (স্পেনীয়: Diego Maradona, স্পেনীয় উচ্চারণ: [ˈdjeɣo maɾaˈðona]; দিয়েগো মারাদোনা নামে সুপরিচিত) একজন আর্জেন্টিনীয় পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় এবং ম্যানেজার ছিলেন। ভক্তদের কাছে এল পিবে দে অরো (সোনালী বালক) ডাকনামে পরিচিত মারাদোনা তার খেলোয়াড়ি জীবনের অধিকাংশ সময় আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স এবং নাপোলির হয়ে একজন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন। তিনি মূলত একজন আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে খেললেও মাঝেমধ্যে দ্বিতীয় আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন। বহু ফুটবল খেলোয়াড় এবং বিশেষজ্ঞ তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে গণ্য করেন। মারাদোনাকে ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং গণমাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯১ সালে ইতালিতে মাদক পরীক্ষায় কোকেইনের জন্য ধরা পড়ায় তাকে ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯৪ ফিফা বিশ্বকাপে ইফিড্রিন পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফলের জন্য তাকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে তিনি তার কোকেইন নেশা ত্যাগ করেন। তার কড়া রীতির জন্য সাংবাদিক-ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ এবং তার মধ্যে বেশ কিছু সময় মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রারম্ভিক জীবন
দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা ১৯৬০ সালের ৩০শে অক্টোবর তারিখে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের লানুসের পলিপলিনিকো (পলিক্লিনিক) আবিতা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার বাবার নাম দিয়েগো মারাদোনা "চিতরো" (মৃত্যু: ২০১৫) এবং তার মায়ের নাম দালমা সালভাদোর ফ্রাঙ্কো "দোনিয়া তোতা" (১৯৩০–২০১১)। তারা উভয়েই কোরিয়েন্তে নদীর তীরে একে অপরের থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরত্বে কোরিয়েন্তেস প্রদেশের উত্তর-পূর্বের এস্কুইনা শহরে জন্মগ্রহণ এবং শৈশব অতিবাহিত করেছেন। ১৯৫০ সালে তারা এস্কুইনা ছেড়ে বুয়েনোস আইরেসে বসতি স্থাপন করেন। মারাদোনা তার শৈশবেই পরিবারে সাথে কোরিয়েন্তেস প্রদেশ থেকে বুয়েনোস আইরেসের দক্ষিণ উপকণ্ঠে অবস্থিত ভিয়া ফিওরিতো-এ স্থানান্তরিত হন এবং সেখানেই তিনি তার শৈশব অতিবাহিত করেছেন। তিনি তার বাবা-মায়ের চার কন্যার সন্তানের পর প্রথম পুত্র ছিলেন। তার দুই ছোট ভাই উগো মারাদোনা (এল তুর্কো) এবং রাউল মারাদোনা (লালো) উভয়ই পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে, মারাদোনাকে একজন প্রতিভাবান স্কাউট তার প্রতিবেশী ক্লাব এস্ত্রেয়া রোহাতে খেলতে দেখে। অতঃপর তিনি উক্ত স্কাউটের বদৌলতে বুয়েনোস আইরেস ভিত্তিক ফুটবল ক্লাব আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্সের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের দল লস সেবায়িতাস-এ (ছোট পেঁয়াজ) যোগদান করেন। একজন ১২ বছর বয়সী বল বয় হিসেবে তিনি প্রথম বিভাগের খেলার প্রথমার্ধের বিরতির সময় বল নিয়ে তার জাদুকরী কুশল প্রদর্শন করে দর্শকদের উল্লসিত করেন। তিনি ব্রাজিলীয় সৃজনশীল খেলোয়াড় রিভেলিনো এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পার্শ্বীয় খেলোয়াড় জর্জ বেস্টকে তার শৈশবে ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
মারাদোনা র্যোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার পিতামাতা ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা সিনিয়র (যিনি একজন মার্কিন ছিলেন) এবং দালমা সালবাদোরা ফ্রাঙ্কো (যিনি ক্রোয়েশীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন)। মারাদোনা ১৯৮৯ সালের ৭ই নভেম্বর তারিখে বুয়েনোস আইরেসে দীর্ঘদিনের বাগদত্তা ক্লাউদিয়া বিয়াফানিয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের দুই কন্যা ছিল, দালমা নেরিয়া (জন্ম:২ এপ্রিল ১৯৮৭) এবং জিয়ানিন্না দিনোরাহ (জন্ম: ১৬ মে ১৯৮৯)। জিয়ানিন্না আর্জেন্টিনীয় আক্রমণভাগের খেলোয়াড় সার্হিও আগুয়েরোর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। অতঃপর ২০০৯ সালে জিয়ানিন্না এবং আগুয়েরোর ঘরে সন্তান জন্মের পর তিনি নানা হয়েছিলেন। মারাদোনার ভাগ্নে এর্নান লোপেস একজন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়, যিনি এক সময় আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্সের হয়ে খেলেছেন।
২০০৪ সালে মারাদোনা এবং বিয়াফানিয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছিল। এরপর থেকে তার কন্যা দালমা দাবি করেছিলেন যে এই বিবাহ বিচ্ছেদ সবার জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান ছিল এবং তার বাবা-মা বিবাহ বিচ্ছেদের পরও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে রয়েছেন। ২০০৫ সালের জুন মাসে, তারা উভয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নাপোলিতে ভ্রমণ করেছিলেন এবং ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনার খেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিবাহ বিচ্ছেদের পর, ক্লাউদিয়া একটি মঞ্চনাট্য প্রযোজক হিসেবে এবং দালমা একজন অভিনেত্রী তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন; তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের অ্যাক্টর'স স্টুডিওতে কাজ করার ইচ্ছা ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলাকালে মারাদোনা স্বীকার করেছিলেন যে তিনি দিয়েগো সিনাগ্রার পিতা (যিনি ১৯৮৬ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর তারিখে নাপোলিতে জন্মগ্রহণ করেছেন)। ইতালির আদালত ইতিমধ্যে ১৯৯৩ সালে এই সম্পর্কে রায় দিয়েছিল, কেননা মারাদোনা তার পিতৃত্ব প্রমাণ বা অস্বীকার করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। দিয়েগো জুনিয়র ২০০৩ সালের মে মাসে ইতালির একটি গলফ কোর্সে মারাদোনার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেছিলেন। অতঃপর ২০০৫ সালে সিনাগ্রা ফুটবল খেলায় অভিষেক করেছিলেন। ২০১৪ সালে মারাদোনার বিরুদ্ধে তার বান্ধবী রোসিও ওলিবা তার উপর নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন, যা তিনি অস্বীকার করেছিলেন।
তার পরিবারের সাথে মারাদোনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং ১৯৯০ সালে স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তার ফোন বিল দেখিয়েছিলেন, যেখানে তিনি তার বাবা-মা এবং ভাইবোনদের ফোন করে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ১৫,০০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করেছিলেন। মারাদোনার মা দালমা ২০১১ সালের ১৯শে নভেম্বর তারিখে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি তখন দুবাইয়ে অবস্থান করছিলেন এবং মরিয়া হয়ে তাকে দেখার জন্য সময়মতো আসার চেষ্টা করেছিলেন, তবে তিনি শেষ পর্যন্ত সময় মতো পৌঁছাতে পারেননি। তার পিতা, "ডন" দিয়েগো ২০১৫ সালের ২৫শে জুন তারিখে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
গ্রেপ্তার
২০১৯ সালের ২৩শে মে তারিখে, বান্ধবী অলিভার দায়ের করা মামলার ফলে মারাদোনা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাদের ছয় বছরের সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর আর্থিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৭৬ কোটি টাকার মামলা করেছিলেন অলিভা। উক্ত মামলায় মেক্সিকো থেকে ফেরার পথে মারাদোনা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
মৃত্যু
২০২০ সালের ২রা নভেম্বর তারিখে মানসিক কারণে মারাদোনাকে লা প্লাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল; সে সময় প্রাক্তন ফুটবলারের একজন প্রতিনিধি দল জানিয়েছিল যে তার অবস্থা গুরুতর নয়। একদিন পর, সাবডুরাল হেমাটোমার চিকিৎসার জন্য তার মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। সফল অস্ত্রোপচারের পর ১২ই নভেম্বর তারিখে তাকে হাসপাতাল হতে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছিল এবং বহির্বিভাগের রোগী হিসেবে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ২০২০ সালের ২৫শে নভেম্বর তারিখে ৬০ বছর বয়সে মারাদোনা আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আয়ার্স প্রদেশের তিগ্রেতে তার নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর পর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা এবং মারাদোনার তিনটি ১০ নম্বর জার্সি (আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স এবং আর্জেন্টিনা) দ্বারা মারাদোনার কফিন মুড়িয়ে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ কাসা রোসাদায় রাখা হয়েছিল। ২৬শে নভেম্বর তারিখে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিততে মারাদোনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানটিতে ভক্তদের দ্বারা উক্ত স্থানের একটি অভ্যন্তরীণ উঠান দখল হওয়ার পর তাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে পর তার পরিবার কর্তৃক অনুষ্ঠানটি সংক্ষিপ্ত করে তার কফিনটি রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের রোতুন্দা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একই দিনে ব্যক্তিগতভাবে মারাদোনার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বুয়েনোস আইরেসের বেলা বিস্তার হারদিন দে বেয়া বিস্তা কবরস্থানে মারাদোনাকে তার বাবা-মায়ের পাশে সমাহিত করা হয়েছে।