সর্বকালের সেরা ভারতীয় সিনেমা-Best Indian movies of all time
Best Indian movies

সর্বকালের সেরা ১০ ভারতীয় সিনেমা-Top 10 Indian Movies of All Time

ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস থেকে সেরা ১০টি সিনেমা বেছে নেওয়া অনেক কঠিন কাজ। সেই কাজটিই করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস’ সংস্থা ‘ফিপ্রেস্কি’। সংস্থাটির ভারতীয় শাখার সারা দেশের ৩০ জন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচকের গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হয়েছে সেরা ১০ ভারতীয় সিনেমা।

তালিকার প্রথম সিনেমাটির নাম সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে বেশির ভাগ জনেরই কোনো দ্বিমত ছিল না। তালিকায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নাম যথাক্রমে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’। সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ও আছে এই সেরা দশের তালিকায়।

‘ফিপ্রেস্কি’র ভারতীয় শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রেমেন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া হয়েছে গোপনে। তাই একজনের সঙ্গে অন্যজনের আলোচনার সুযোগ ছিল না। ৩০ জন সমালোচকের তালিকা থেকে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ১০টি সিনেমা নিয়ে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয়েছে।

১৫০ জনের বেশি পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, সমালোচকের ভোটে তৈরি হয়েছে এই তালিকা। ভারতে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মুক্তি পাওয়া আট ভাষার ৭৫০টির বেশি সিনেমা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে এই ১০ সিনেমা।

পথের পাঁচালী, ১৯৫৫

পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি। চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রর প্রথম, দুই শিল্পীদেরও প্রথম—অনেক ‘প্রথম’ নিয়ে নির্মিত ছবিটি মুক্তির পরেই ইতিহাস গড়ে। এটিই ভারতের প্রথম সিনেমা, যা বিশ্ব চলচ্চিত্রে সাড়া ফেলে, মুক্তির এত বছর পরেও অনেক নির্মাতা প্রেরণা খুঁজে নেন ছবিটি থেকে। ফিপরেস্কি ইন্ডিয়ার সদস্যদের ভোটে সর্বকালের সেরা ছবি হয়েছে পথের পাঁচালী। এর আগে এটি জায়গা পেয়েছিল প্রখ্যাত সমালোচক রজার এবার্টের ‘সেরা ছবি’র তালিকাতেও। ছিল ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায়। 

এ ছাড়া ২০১৮ সালে বিবিসির করা সমালোচকদের চোখে সেরা অ-ইংরেজিভাষী সিনেমার তালিকায় ‘পথের পাঁচালী’ ছিল ১৫ নম্বরে। আকিরা কুরোসাওয়ার প্রিয় এক শ ছবির তালিকারও শীর্ষে ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি। এই সময়ের প্রখ্যাত নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলানেরও প্রিয় সিনেমা এটি।

মেঘে ঢাকা তারা, ১৯৬০

তালিকার দুইয়ে রয়েছে আরেক প্রখ্যাত বাঙালি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ ছিল ‘অপু ট্রিলজি’র প্রথম কিস্তি। ঋত্বিকের ছবিটিও তাঁর ‘দেশভাগ ট্রিলজি’র প্রথম কিস্তি।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থী নীতার (সুপ্রিয়া চৌধুরী) চোখ দিয়ে দেশভাগের পরের অবস্থা তুলে ধরেছেন পরিচালক। মনে করা হয়, ঋত্বিকের এ ছবিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরিচালকের মৃত্যুর পর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আরও বেশি কদর পায়। ভারত তো বটেই, ঋত্বিক হয়ে ওঠেন বিশ্ব চলচ্চিত্রে সমীহ জাগানো এক নাম।

ভুবন সোম, ১৯৬৯

মৃণাল সেন পরিচালিত ছবিটিকে ভারতের নিউ ওয়েভ সিনেমার অন্যতম পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়। দেশটির জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম দিককার সিনেমা ‘ভুবন সোম’। হিন্দি ছবিটির জন্য পরিচালক মৃণাল সেন, অভিনেতা উৎপল দত্ত জাতীয় পুরস্কার পান। ছবিটিতে শহুরে ও গ্রামীণ ভারতের বিভাজনের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা, মমত্ববোধও তুলে ধরেন পরিচালক। ছবিতে ধারা বর্ণনাকারী ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, ‘ভুবন সোম’ দিয়েই শুরু হয় তাঁর চলচ্চিত্র-যাত্রা।

সত্য,১৯৯৮

১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সত্য’ বদলে দেয় হিন্দি সিনেমার চেনা চিত্র। ক্রাইম ঘরানার এই সিনেমায় মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ডের যে বাস্তব চিত্র উঠে এসেছিল, তা ‘সত্য’র আগে খুব কম ছবিতেই দেখা গেছে। বিনোদনের অনেক উপাদান মজুদ, সঙ্গে শৈল্পিক নির্মাণÑ পরে তাই সর্বকালের সেরা হিন্দি সিনেমাগুলোর একটির স্বীকৃতি পেয়েছে ছবিটি। গত জুলাই মাসে ‘সত্য’ মুক্তির ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। গ্রাম থেকে আসা এক তরুণের মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ার গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সত্য’। ছবিটির পরিচালক যে ভারতের অন্যতম সেরা নির্মাতাদের একজনÑরামগোপাল ভার্মা, সে কথা এত দিনে অনেকেই জেনে গেছেন। ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেন মনোজ বাজপেয়ি, ঊর্মিলা মাতন্ডকর, সৌরভ শুক্লা প্রমুখ। তবে ‘ভিকু মহাত্রে’ চরিত্রে অভিনয় করে মনোজ বাজপেয়ির অভিনয় ক্যারিয়ার পুরোপুরি বদলে যায়। আগে যেখানে তিনি ছোটখাটো পার্শ্বচরিত্রের প্রস্তাব পেতেন, ‘সত্য’ মুক্তির পর বদলে যায় সে দৃশ্যপট।

ঘাটশ্রাদ্ধ, ১৯৭৭

কন্নড় সিনেমার অন্যতম পরিচালক গিরিশ কাসারাভাল্লির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা এটি। ২০০২ সালে ন্যাশনাল আর্কাইভ অব প্যারিসে এক শ সিনেমার মধ্যে একমাত্র ভারতীয় ছবি হিসেবে জায়গা পায় ঘাটশ্রাদ্ধ। ২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়ায় ১৬ লাখ ভোট পেয়ে সেরা ২০ ভারতীয় সিনেমার একটি হয় ‘ঘাটশ্রাদ্ধ’।

গরম হাওয়া, ১৯৬৫

গরম হাওয়া ও গাইড

ভারত ভাগের পর এক মুসলিম ব্যবসায়ী ও তার পরিবারের সংগ্রাম নিয়ে এম এস সথ্যুর সিনেমা ‘গরম হাওয়া’ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আশঙ্কায় ছবিটি বছরখানেক আটকে রাখার পর ছাড়পত্র দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ড। তবে মুক্তির পর দর্শক, সমালোচক উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। উর্দু লেখিকা ইসমত চুগতাইয়ের অপ্রকাশিত গল্প অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন কাইফি আজমি ও শামা জাইদি। ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র মনে হয় এটিকে।

ফিল্ম কম্পানিয়নের করা সর্বকালের সেরা দশ ভারতীয় সিনেমার তালিকার ১০ নম্বরে ‘গরম হাওয়া’র সঙ্গে যৌথভাবে জায়গা পেয়েছে ‘গাইড’। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া বিজয় আনন্দ পরিচালিত সিনেমাটির প্রধান দুই চরিত্রে দেখা যায় দেব আনন্দ এবং ওয়াহিদা রেহমানকে। এটি তৈরি হয় আর কে নারায়ণের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে। সি ডি বর্মণের করা সিনেমার গানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বলিউডের অন্যতম ক্ল্যাসিক সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ‘গাইড’কে।

চারুলতা, ১৯৬৪

সর্বকালের সেরা ভারতীয় সিনেমার তালিকায় সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি ‘চারুলতা’। তালিকার তিনিই একমাত্র পরিচালক, যার দুটি সিনেমা স্থান পেয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিকে নিজের অন্যতম প্রিয় বলে অভিহিত করেছিলেন সত্যজিৎ। ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সমালোচকেদের সেরা ছবির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিল ‘চারুলতা’। এটি প্রয়াত নির্মাতা জঁ-লুক গদারের সব সময়ের প্রিয় ছবির একটি। ১৯৯৬ সাল থেকে দ্য একাডেমির আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ‘চারুলতা’।

অঙ্কুর, ১৯৭৪

হায়দরাবাদে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দিয়ে নির্মাতা হিসেবে যাত্রা শুরু করেন শ্যাম বেনেগাল। ছবিটি নির্মিত হয় স্থানীয় কৃষকদের অর্থায়নে। ২৪তম বার্লিন উৎসবে সোনার ভালুকের জন্য লড়েছিল ছবিটি। লক্ষ্মী ও সূর্য চরিত্রটির জটিল বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে জাত বৈষম্য, ধনী-গরিব বৈষম্যসহ নানা সামাজিক বিষয়কে তুলে ধরেছেন পরিচালক।

পিয়াসা, ১৯৫৭

বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ঘরানার সিনেমার মিশ্রণের অন্যতম সেরা উদাহরণ মনে করা হয় গুরু দত্তের সিনেমাটিকে। এতে ওয়াহিদা রেহমানের গুলাবো চরিত্রটি তৈরি হয়েছে বাস্তব চরিত্রের প্রেরণায়। ছবির অন্যতম চিত্রনাট্যকার আকবর আলভির একবার গুলাবো নামে এক যৌনকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার কাছ থেকেই চরিত্রটির প্রেরণা নেন তিনি। ছবিটিতে প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেওয়ায় পরে আফসোস করেছেন দিলীপ কুমার। ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় ছিল ‘পিয়াসা’।

শোলে,১৯৫৭

বলিউডের ইতিহাসে ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের নাম ‘শোলে’। ১৯৭৫ সালে মুক্তির পরপরই সাড়া জাগিয়েছিল ছবিটি। এই ছবি তৈরির টাকাই ছিল না শুরুতে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সেই দিনের সংকটের কথা জানালেন ছবির পরিচালক। ‘শোলে’ ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন একঝাঁক বলিউড তারকা। তাঁরা হলেন সঞ্জীব কুমার, অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনি, জয়া বচ্চন প্রমুখ। বক্স অফিস সফলতার পাশাপাশি ভারতের একটি ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের মর্যাদাও পেয়েছে ‘শোলে’। রমেশ সিপ্পির ছবিটি জায়গা পেয়েছে ফিল্ম কম্পানিয়নের তালিকার শীর্ষে।

তথ্যসূত্র: prothomalo.com