হার্ট অ্যাটাকের কারণ ও প্রতিরোধ - Heart attack causes and prevention
হৃদযন্ত্রের নিজস্ব রক্ত সরবরাহ হঠাৎ যে কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্টের একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এই ঘটনাকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলা হয়।
বিভিন্ন কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের প্রধান কারণ হলো রক্তনালি সংক্রান্ত হৃদরোগ বা করোনারি হার্ট ডিজিজ। এছাড়া রক্তে অক্সিজেনের অভাব অথবা মাদকের অপব্যবহারের কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কিছু বিষয়ের কারণে করোনারি হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন-
• ধূমপান
• উচ্চ রক্তচাপ
• রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল থাকা
• অস্বাস্থ্যকর চর্বিবহুল খাবার খাওয়া
• শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
• অতিরিক্ত ওজন
• ডায়াবেটিস ইত্যাদি।
হার্ট অ্যাটাক কী?
হার্ট অ্যাটাক একটি বিশেষ রোগ। হার্ট পাম্পের মাধ্যমে আমাদের সারা শরীরের রক্ত সঞ্চালন করে। হার্টের নিজস্ব রক্ত চলাচলের পদ্ধতি রয়েছে, এর কিছু নিজস্ব রক্তনালি আছে। এই রক্তনালিগুলোর মধ্যে চর্বি বা কোলেস্টেরল জমে এক বা একাধিক নালি যদি হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হার্টের বেশ কিছু অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে গেলে হার্টের কাজ করার ক্ষমতাও বন্ধ হয়ে যায়। এটিই হলো হার্ট অ্যাটাক।
যেসব কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়
• অতিরিক্ত মাত্রায় ধূমপান করলে বা অ্যালকোহল গ্রহণ করলে
• দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় তেল বা চর্বি জাতীয় খাবার খেলে
• সবসময় মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে
• রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে
• উচ্চ রক্তচাপ হলে
• ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে
• কায়িক পরিশ্রম না করা
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
বুকে ব্যথা: হার্ট অ্যাটাক হলে সাধারণত বুকের মাঝখানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। আস্তে আস্তে সেই ব্যথা চোয়ালে, বাম কাঁধ ও হাতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
শ্বাসকষ্ট ও দম ফুরিয়ে যাওয়া: যদি আপনার শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনো সমস্যা না থাকে এবং হঠাৎ করে শ্বাস নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়, তবে সেটা খারাপ লক্ষণ। মূলত হৃদরোগ থেকে ফুসফুসে পানি জমাসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে ঠান্ডা না থাকার পরও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অল্পতেই দম ফুরিয়ে যাওয়া, মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়াও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ।
অতিরিক্ত ঘাম হওয়া: অতিরিক্ত ঘাম হওয়া হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা হওয়া ছাড়াও অতিরিক্ত ঘাম, বুক ধড়ফড়, হঠাৎ শরীর খারাপ লাগতে শুরু করলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
কাশি: আপনার যদি দীর্ঘদিন কাশির সমস্যা থাকে, এবং তার সঙ্গে সাদা বা কিছুটা ঘোলাটে কফ বের হয়, তবে বুঝতে হবে আপনার হার্ট ঠিকমতো কাজ করছে না। ভবিষ্যতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তবে হ্যাঁ, কাশি সব সময় হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নাও হতে পারে। কফের সঙ্গে নিয়মিত রক্ত বের হলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থেকেই যায়।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া: যদি কাজ করার মধ্যে আপনি প্রায়ই হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যান, তাহলে বুঝবেন হার্টের সমস্যা রয়েছে।
তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়া: আপনি কি অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন? কিছুক্ষণ কাজ করলে বুক ধড়ফড় করে? তবে আপনি এখনই কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে মহিলাদের হার্টের সমস্যার প্রধান লক্ষণ এটি।
মাথাব্যথা: যখনই প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, আমরা ওষুধ খেয়ে থাকি। কিন্তু জানেন কি, হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম লক্ষণ হলো প্রতিদিনের প্রচণ্ড মাথাব্যথা?
অনিয়মিত পালস রেট: আপনি যদি অনেক বেশি নার্ভাস থাকেন বা কোথাও থেকে দৌড়ে আসেন আপনার পালস রেট ওঠা-নামা করতে পারে। তবে এটি যখন কোনো কারণ ছাড়াই হয়, তবে তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হার্ট অ্যাটাকের আগে এমনটি হয়ে থাকে।
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধের উপায়
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো জীবনধারায় স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনা। ইতোমধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এমন ব্যক্তিও সুস্থ জীবনধারা মেনে চলার মাধ্যমে পুনরায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারবেন।
১.ধূমপান ত্যাগ
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ধূমপান করা। ধূমপান ধমনীকে শক্ত ও সরু করে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে এবং রক্তচাপ বাড়ায়। এভাবে এটি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
২.রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে তা রোগীর ধমনী ও হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার মাধ্যমে প্রায়ই উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।
৩.ওজন নিয়ন্ত্রণ
ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত হলে হার্টকে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। বিএমআই ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে শরীরের উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক ওজন কত সেটি জানা যায়।মনে রাখতে হবে, এক-দুই কেজি ওজন কমাতে পারলে সেটিও রক্তচাপ ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
৪.মদপান পরিহার
নিয়মিত অতিরিক্ত পরিমাণে মদপান করলে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে এটি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা একবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরে মদপান করা কমিয়ে দেয় তাদের তুলনায় যারা টানা মদপান চালিয়ে যায় তাদের পুনরায় হার্ট অ্যাটাক অথবা ব্রেইন স্ট্রোকের মতো মারাত্মক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ।
৫.স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্যাভ্যাস
ডায়েটে চর্বিবহুল খাবার থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অস্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাসের কারণে ধমনীগুলো ক্রমশ শক্ত ও সরু হতে থাকে। ফলে রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ আরও বাধাগ্রস্ত হয় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ মাত্রায় চর্বিবহুল খাবার খাওয়া চালিয়ে গেলে ধমনীর ভেতরে আরও কোলেস্টেরল প্ল্যাক জমতে থাকে। এর কারণ হলো, চর্বিবহুল খাবারে অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল থাকে।
৭.ব্যায়াম করা
দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে আরও সচল হওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করার ফলে হার্ট ও রক্তনালীগুলো সুস্থ থাকে। এভাবে রক্তচাপ কমে আসে। নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতেও সাহায্য করে। ফলে রক্তচাপ কমানো আরও সহজ হয়। সাধারণত হাঁটা, সাঁতার কাটা ও সাইকেল চালানোর মতো কম শ্রমসাধ্য ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
চিকিৎসা
হার্টের রক্তনালির রক্ত চলাচল পুনঃপ্রতিস্থাপন করাই এর প্রধান চিকিৎসা। যত দ্রুত চিকিৎসা প্রদান করা যায়, রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তত বেশি ও দ্রুত হয়। এ ছাড়া, আধুনিক চিকিৎসা হলো অ্যানজিওগ্রামের মাধ্যমে হার্টের ব্লক শনাক্ত করে দ্রুত তা অপসারণ করা এবং রক্ত চলাচল পুনঃপ্রতিস্থাপন করা। বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধের মাধ্যমে রক্তজমাট ভেঙে দেওয়া হয় এবং রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।