আমাশয় রোগের কারণ ও প্রতিকার
আমাশয় ইংরেজিতে বলে Dysentery, মানব অন্ত্রে রোগজীবাণুর সংক্রমণজনিত রোগ। এন্টামিবা হিস্টোলিটিকা' নামে এক ধরনের পরজীবী জীবাণু আছে। সেই জীবাণু দ্বারা বৃহদন্ত্রের সংক্রমণ ও প্রদাহকে আমাশয় বলে। আমাশায় আক্রান্ত রোগীর মল দিয়ে এই জীবাণুর সিট নির্গত হয়। এই সিস্ট কোনোভাবে খাবারের সঙ্গে মিশে গিয়ে অন্য কোনো লোকের পেটে ঢুকলে সেই ব্যক্তিও সংক্রামিত হয়। এটি সাধারণত ৩-৭ দিন স্থায়ী হয়। কিন্তু আমাশয় দীর্ঘস্থায়ী ও হতে পারে।
প্রকারভেদ
আমাশয় দুই ধরনের হয়ে থাকে: অ্যামিবাঘটিত আমাশয় এবং দণ্ড-ব্যাকটেরিয়াঘটিত (ব্যাসিলারি) আমাশয়। এদের সংক্রমণের কারণ ভিন্ন, রোগের লক্ষণ ভিন্ন এবং চিকিৎসাও ভিন্ন।
অ্যামিবাঘটিত আমাশয়
অ্যামিবাঘটিত আমাশয় (Amoebic dysentery, Amoebiasis) বড় ছেলে-মেয়েদের হয়ে থাকে কিন্তু ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এর প্রবণতা অত্যন্ত কম৷ পরিপাকতন্ত্রের বৃহদান্ত্রে এন্ট্যামিবা হিস্টোলাইটিকা নামক পরজীবীর সংক্রামণের ফলে এই রোগ হয়৷
সংক্রমণের কারণ
এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা নামীয় পরজীবীটি নিজের চারদিকে এক ধরনের আবরণ গঠন করে মাটিতে ও পানিতে বিচরণ করে৷ সাধারণতঃ দূষিত পানি এবং অপরিচ্ছন্ন খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা মানুষের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং বৃহদান্ত্রের সিকামের কাছাকাছি জায়গায় গিয়ে এর বাইরের আবরণটি খুলে ফেলে৷ এরপর পরজীবীটি বৃহদান্ত্রের গায়ে যে শ্লেষ্মাঝিল্লি আছে তা আকড়ে ধরে বাসা বাঁধে। পরজীবীটির দেহ থেকে এক প্রকার ক্ষতিকারক রস নিঃসরণ হয় যা অন্ত্রে গাত্রের শ্লেষ্মাঝিল্লিকে ভেঙে দেয়। আর এই ভেঙ্গে যাওয়া শ্লেষ্মাঝিল্লিতে এ্যমিবার আক্রমণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়৷ শ্লেষ্মাঝিল্লির ঝরে পড়া অংশ মলের সঙ্গে নিঃসৃত হয় যাকে “আম” বলে আখ্যায়িত করা হয়। তলপেটে সাধারণত ডানপাশে চিনচিনে ব্যথা হয়৷ তলপেটের ডান পাশে সিকাম থাকে যা পরজীবীটির আক্রমণের মূল লক্ষ্য।
রোগের লক্ষণ
রোগীর বারবার পাতলা পায়খানা হতে থাকে। মলের সঙ্গে মিউকাস (শ্লেষ্মাঝিল্লি) বা আম বেশি থাকে। রক্ত থাকলেও কম৷ সাধারণত ডানদিকের তলপেটে ব্যথা হয়৷
চিকিৎসা
যে কোন প্রকারের আমাশয়ে প্রথম করণীয় হলো খাওয়ার স্যালাইন গ্রহণ করা। অধিকন্তু রোগীকে প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে৷ ডিহাইড্রেশান প্রতিরোধের স্বার্থে প্রচুর পরিমাণে তরল ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে৷ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ট্যাবলেট মেট্রোনিডাজল (৪০০ মি.গ্রা.) ১টা দিনে ৩ বার করে ৫ দিন (পূর্ণ বয়স্কদের ক্ষেত্রে) খেতে হবে৷ ডাক্তার ওজন অনুযায়ী শিশুদের চিকিৎসা দেবেন।
দণ্ডাণুঘটিত আমাশয়
দণ্ডাণুঘটিত আমাশয় (ইংঃ Bacillary dysentery, Shigellosis) শিগেলা নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা অন্ত্রের সংক্রমণের কারণে হয়। এ রোগটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক হারে দেখা যায় এবং বহু লোকের মৃত্যুর জন্য এই রোগ দায়ী৷ দণ্ডাণুঘটিত আরেক নাম শিগেলাধিক্য রোগ বা শিগেলোসিস৷ শিগেলা নামে এক প্রকার ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে এই রোগটি হয়৷ শিগেলার চারটি প্রজাতির মধ্যে Shigella flexneri নামক প্রজাতিটির মাধ্যমে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে আমাশয় ছড়ায়। এটি সবচেয়ে বেশি ছড়ায় জীবাণুবাহী আধোয়া হাত দিয়ে। জীবণুবাহী মাছি ও খাবারের মাধ্যমেও ছড়ায়। মলের সঙ্গে রক্ত বেশি যায় বলে এটিকে এক সময় রক্ত আমাশয় বলা হতো।
সংক্রমণের পদ্ধতি
২ থেকে ৫ বছরের শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়৷ এ রোগের প্রধান উৎস হলো রোগীর মল৷ মাছির মাধ্যমে রোগজীবাণু খাদ্য ও পানীয়তে সঞ্চারিত হয়৷ এ সকল দূষিত খাদ্য ও পানীয় পান করার ফলে রোগের সংক্রামণ হয়৷ শিগেলা জীবাণুটি মানুষের পেটে ঢুকে পাকস্থলী অতিক্রম করে চলে যায় ক্ষুদ্রান্ত্রে৷ সেখানে জীবাণুটি বংশবৃদ্ধি করে এবং বৃহদান্ত্রে ঘায়ের সৃষ্টি করে৷ ঝিল্লি ফুলে উঠে ও লাল হয়ে যায়৷ ঝিল্লিতে পুঁজের আবরণ পড়ে এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়৷ সামান্য আঘাতেই এই ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয়৷ তাই মলের সঙ্গে রক্ত যায়৷
রোগের লক্ষণ
হঠাৎ করে ঘন ঘন পাতলা পায়খানা শুরু হয় এবং চিকিৎসা নিতে দেরি হলে দিনে ১০ বারের বেশি মলত্যাগ করতে হয়। আক্রান্ত রোগীর পেটে ব্যথা করতে থাকে। রোগীর শরীরে খিঁচুনি হতে পারে৷ রোগীর গায়ের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। জ্বর হয়। তাপমাত্রা ১০২-১০৩ ডিগ্রি ফারেনহিট পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। অনেকবার মলত্যাগের কারণে শরীরে ফলে পানিস্বল্পতা ও ইলেকট্রোলাইট ঘাটতি দেখা দেয়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
চিকিৎসা
প্রথমেই বারবার মলত্যাগ বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া যে কোন প্রকারের আমাশয়ে প্রথম করণীয় হলো খাওয়ার স্যালাইন গ্রহণ করা। অধিকন্তু রোগীকে প্রথমতঃ বিশ্রাম নিতে হবে। ডিহাইড্রেশন ঠেকানোর জন্য প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর খাওয়ার স্যালাইন গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ তরল খাবার যেমন ভাল ঠাণ্ডা পানি, চিনির সরবত, ডাবের পানি, ফলের রৎস ইত্যাদি খেতে হবে৷ অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা হলে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ খেতে হবে৷ সিগেলা প্রজাতির আমাশয়ে ডাক্তারের পরামর্শমত এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগ পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।
আমাশয় প্রতিরোধে করণীয়
১.সবসময় বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে এবং দাঁত ব্রাশ করার সময়ও বিশুদ্ধ পানি ব্যাবহার করতে হবে।
২.মলত্যাগের পরে হাত বিশুদ্ধ পানি ও হ্যান্ডওয়াস বা সাবান দিয়ে ভালো করে ধোয়া।
৩.খাবার গ্রহণের পূর্বে এবং রান্না করার আগে অবশ্যই হাত পানি ও হ্যান্ড ওয়াশ বা সাবান দিয়ে ভালো করে ধুতে হবে।
৪.বাইরের খাবার কম খেতে হবে।
৫.খোসাযুক্ত ফল বা সবজি খাওয়ার পূর্বে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
৬.ব্যবহৃত পোশাক, তাওয়াল হালকা গরম পানি ও ডিটারজেন্ট পাওডার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
৭.একজনের তাওয়াল আরেকজনের ব্যাবহার করা যাবে না।
৮.শিশুদের হাত ধোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে।
৯.সুইমিংপুলে সাঁতার কাটার সময় পানি গিলে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
১০.অসুস্থ শিশুর ডায়াপার পরিবর্তন করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া