
জরায়ু নিচে নেমে যাওয়ার কারন চিকিৎসা ও প্রতিকার
অনেক সময় বিভিন্ন কারণে জরায়ু নিচের দিকে নেমে যায়। একে ইউটেরাল প্রলাপস বা পদ্মরোগও বলা হয়। নারীদেহের হাজারও সমস্যার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে জরায়ু নেমে আসা। গর্ভধারণকালে নারীর তলপেটের ভিতরে অবস্থিত জরায়ুর ভিতরে ভ্রূণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় কিছু মাংসপেশী এবং রগ (লিগামেন্ট এক ধরনের বন্ধনী যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে যথাস্থানে আটকে রাখতে সাহায্য করে) জরায়ুকে ধরে রাখে। কোনো কারণে এই পেশী ও রগগুলো ছিঁড়ে যায়, ঢিলা হয়ে যায় অথবা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন জরায়ু যথাযথ স্থানে আর থাকতে পারে না এবং ক্রমান্বয়ে যোনিপথ দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।
জরায়ু
জরায়ু বা গর্ভ মানুষসহ বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জননতন্ত্রের একটি প্রধান হরমোন-প্রতিক্রিয়াশীল স্ত্রী গৌণ-জননাঙ্গ। জরায়ুতে যা ঘটে তাকে ‘ইন ইউটেরো’ বলে বর্ণনা করা হয়। মানুষের ক্ষেত্রে, জরায়ুর নিম্নপ্রান্ত, জরায়ুমুখ, যোনিপথে উন্মুক্ত হয় এবং এর ঊর্ধ্বাংশ, ফান্ডাস, ডিম্বনালীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। গর্ভকালে এই জরায়ুর মধ্যেই গর্ভস্থ ভ্রূণ বড়ো হতে থাকে। মানুষের ভ্রূণাবস্থায়, জরায়ু প্যারামেসোনেফ্রিক নালী থেকে একটি একক অঙ্গে রূপান্তরিত হয়, যাকে সরল জরায়ু বলে।
জরায়ু নিচে নেমে যাওয়ার কারণ সমূহঃ
১। জন্মগতঃ যেসব মাংস পেশি জরায়ুকে সঠিক স্থানে ধরে রাখে , তাদের কারো জন্মগত দুর্বলতা থেকে থাকে।
২। জন্মের পরঃ জন্মের পরের বলতে এক্ষেত্রে আমরা সন্তান ধারণের সময়টাকেই বুঝি । সন্তান জন্মধারণের পরে বেশ কিছু কারণে প্রলাপস হতে পারে। জরায়ুমুখ সম্পূর্ণ রকমে খোলার আগেই যদি চাপ দেয়া হয়, অতিরিক্ত টানাটানির কারণে হতে পারে। ডেলিভারি বিলম্বিত হলে, প্লাসেন্টা বের করার জন্যে জরায়ুতে নিচের দিকে অতিরিক্ত চাপ দিলে। অনেক বেশি সন্তান ধারণের ফলে হয়। মা খালা দের মধ্যে যাদের চার – পাঁচ টা নরমাল ডেলিভারি হয়েছে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের প্রায় সবারই একটু হলেও এই সমস্যাটা আছেই । বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাংস পেশি দুর্বল হয়ে যায় এবং ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে আসতে থাকে। হরমোনাল সাপোর্টের অভাবও একটি বড় কারণ।
প্রলাপসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
১। প্রথম ডিগ্রিঃ জরায়ু মুখ তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে কিছুটা নিচে নেমে আসে। কিন্তু যোনি ছিদ্রের বাইরে অবস্থান করে না।
২। দ্বিতীয় ডিগ্রিঃ জরায়ু মুখ যোনি ছিদ্রের বাইরে বের হয়ে আসে। কিন্তু জরায়ুর শরীরের বেশির ভাগ অংশই ভিতরে থেকে যায়। সবসময় বেরও হয়ে আসে না। কাশি দিলে, প্রস্রাব করতে গেলে বের হয় আসে। এমন কি বের হলেও হাত দিয়ে ঢুকিয়ে ফেলা যায়।
৩। তৃতীয় ডিগ্রিঃ জরায়ু মুখ তার শরীর সহ সম্পূর্ণ রূপে বাইরে বের হয়ে আসে এবং আর ভিতরে ঢুকানো যায় না ফলে প্রস্রাব ও পায়খানা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এই স্টেজে গেলে অপারেশন করা অতিশয় জরুরী হয়ে দাঁড়ায়।
লক্ষণ
কোনো কোনো ক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।
১. অস্বস্তিকর অনুভূতি। ঋতুস্রাবের রাস্তায় কোনো কিছু বের হয়ে আসছে বা জায়গাটা ভরা ভরা মনে হবে।
২. দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কোমরে ব্যথা হতে পারে।
৩. ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাব অসম্পূর্ণ হওয়ার অনুভূতি, অনেক সময় অনবরত প্রস্রাব ঝরা, যদি স্ফিংটার ঢিলে হয়ে যায়।
৪. কোষ্ঠকাঠিন্য, পায়খানা অসম্পূর্ণ হওয়ার অনুভূতি।
৫. সাদাস্রাব, পুঁজমিশ্রিত বা লালচে স্রাব যেতে পারে।
চিকিৎসা
জরায়ুর মুখ কিছুটা বা সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। ব্যায়ামে (কেগেল এক্সারসাইজ) পেলভিক মাংসপেশি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বয়স কম এবং সন্তান নিতে আগ্রহীদের ক্ষেত্রে জরায়ু আগের জায়গায় প্রতিস্থাপন করাই হলো চিকিৎসা। সন্তান নিতে আগ্রহী না হলে অথবা বয়স ৫০ বছরের বেশি এবং মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে, এমন রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলা হয়।
প্রতিরোধ
শিক্ষার অভাব, কুসংস্কারে জর্জরিত আমাদের দেশ, সমাজ তথা পরিবার এ ধরনের অসুবিধায় লজ্জার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে পানি পড়া, ঝাড়ফুঁক, লতাপাতার ওষুধ ব্যবহার করে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। অথচ একটু সচেতন হলেই এ দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।
জন্মগতভাবে লিগামেন্ট ঢিলে হলে প্রতিরোধ সম্ভব নয়। কিছু বিষয় খেয়াল করলে প্রতিরোধ করা যায়।
১. জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে ঘন ঘন সন্তান প্রসব রোধ করা।
২. প্রসবব্যথা যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী-নার্স দিয়ে প্রসব করাতে হবে।
৪. প্রসূতি অবস্থার বা প্রসবের পর ছয় মাস কোনো ভারী কাজ করা যাবে না।
৫. কোষ্ঠকাঠিন্য প্রস্রাব আটকে গেলে, টিউমার বা প্রসবের রাস্তায় অস্বস্তি বোধ করলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
৬. প্রসবের পর হালকা ব্যায়াম করতে হবে।
সতর্কতা
সন্তান প্রসবের সময় পাশে অভিজ্ঞ ধাত্রী থাকা বা হাসপাতালে যাওয়া উচিত।
প্রসব-পরবর্তী সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। সাধারণভাবে বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের পর ছয় মাসের মধ্যে কোনো ভারী কাজ করা চলবে না।
প্রসব-পরবর্তী যথাসম্ভব দ্রুত স্বাভাবিক হাঁটাচলা শুরু করা উচিত।
জরায়ুর আশপাশের মাংসপেশিগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম আছে। এগুলো নিয়মিত করা উচিত।
দীর্ঘমেয়াদি কাশি ও কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে।
সঠিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।