গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালাপোড়ার ঘরোয়া সমাধান
সন্তান ধারণের সময় প্রতিটি নারীকে শারীরিক এবং মানসিক কিছু সমস্যার মধ্যে দিয়ে পার করতে হয়। মুড সুইনিং, রক্ত স্বল্পতা, অতিরিক্ত রাগ, বমি বমি ভাব ইত্যাদি সমস্যার সাথে সাথে বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাসের সমস্যা দেখা দেয়। এই সময় নারীর শরীরে হরমোনগত পরিবর্তন আসে যার কারণে এই ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। বুক জ্বালাপোড়া অথবা গ্যাস মায়েদের মধ্যে এক ধরণের চাপ ও অস্বস্তি তৈরি করে। শুধু তাই নয় বুক জ্বালাপোড়ার কারণে ঠিকমত খেতে এবং ঘুমাতে পারে না। যা অনাগত শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
গর্ভাবস্থায় বুকজ্বালার কারণ
আপনার শরীরে একটি ভালভ রয়েছে যা আপনার সবেমাত্র খাওয়া খাবার এবং পাচক অ্যাসিড রাখে যা হজম করার জন্য দায়ী। যখন এই ভালভে আপোস করা হয়, এটি বুকজ্বালা সৃষ্টি করে। আপনার বুকজ্বালা হতে পারে এমন বেশ কিছু কারণ আছে। গর্ভাবস্থায় এটি আপনাকে প্রভাবিত করার প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
* প্রজেসটেরোন নামক একটি হরমোন ভালভকে শিথিল করতে পারে, যার ফলে আংশিকভাবে হজম হওয়া খাবার এবং কিছু পাকস্থলীর অ্যাসিড ভালভে থেকে যেতে পারে। এটি বুকে এবং উপরের পেটে জ্বালার সংবেদন তৈরি করতে পারে।
* বদহজম।
* সকালের অসুস্থতা।
* ম্যাক্রোসোমিয়া নামক একটি অবস্থা (এটি হয় যখন আপনার শিশুর খুব বড় হয় এবং আপনার পেটে সম্মুখের দিকে চাপা সৃষ্টি করে, অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে জমিয়ে রাখে)।
* আপনি যদি একাধিক শিশুর সাথে গর্ভবতী হন (এতে শিশুদের মধ্যে একজন পেটের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা সম্প্রতি হজম করা খাবার ও পাকস্থলীর অ্যাসিডকে খাদ্যনালীর মধ্যে জমিয়ে দেয়)।
* গর্ভাবস্থার শেষের দিকে, আপনার শিশু একটি নিম্ন-প্রথম বা ব্রীচ অবস্থানে থাকলে বুকজ্বালার কারণ হতে পারে (এটি আপনার ডায়াফ্রামে বেশি চাপ দিতে পারে এবং বুকজ্বালার কারণ হতে পারে)।
গর্ভাবস্থায় এসব সমস্যা থেকে বাঁচার উপায়
সন্তান ধারণের সময় প্রজেস্টেরন(progesterone) নামক হরোমন বৃদ্ধি পায় যা পেটে গ্যাস সৃষ্টি করে। এমনকি এটি হজমক্ষমতা হ্রাস করে বমি বমি ভাব, পেট ফাঁপা সমস্যার উদ্ভব করে। খাবারের অনিয়ম, ভাঁজাপোড়া খাবার বেশি খাওয়া, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ইত্যাদি বুক জ্বালাপোড়ার জন্য দায়ী। পাইলোরি(Pylori) নামক ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে সমস্যা তৈরি করে। যার কারণে বমি বমি ভাব এবং বুক জ্বালাপোড়া দেখা দেয়।
আদা:
বমি বমি ভাব, পেটের গ্যাস্ম বদহজমের সমস্যা দূরে আদা বেশ কার্যকর। আদাতে জিনজারলোস( gingerols) এবং শাগোলোস( shgaols) নামক দুটি উপাদান রয়েছে যা পেটের সমস্যা দূর করে থাকে। একটি আদা কুচি, এক কাপ পানিতে জ্বাল দিন। এরসাথে আপানর পছন্দমত লেবু বা মধু যোগ করতে পারেন। জ্বাল হয়ে আসলে এটি চুলা থেকে নামিয়ে ফেলুন। খাবার খাওয়ার আগে অথবা পরে এটি পান করুন।
মৌরি:
দুই চা চামচ মৌরি আধা কাপ পানিতে জ্বাল দিন। ১০ মিনিট ফুটতে দিন। তারপর ঠান্ডা হলে এটি পান করুন। বুক জ্বালাপোড়া দেখা দিলে এটি পান করুন। এটি তাৎক্ষনিক আরাম দিবে।
প্রচুর পানি পান:
পানি সবচেয়ে ভাল উপশম। চেষ্টা করুন দিনে আট থেকে দশ গ্লাস পানি পান করা। পানির পরিবর্তে তরল জাতীয় খাবার যেমন যেকোন ফলের রস (আঙ্গুর, কমলার, আপেল, ডাব ইত্যাদি) পান করতে পারেন। পানির পরিমাণ বেশি এমন সবজি এবং ফলও খেতে পারেন।
অল্প খাওয়া:
একসাথে অনেক খাবার না খেয়ে অল্প পরিমাণে বার বার খাওয়া যেতে পারে। গ্যাসের সমস্যা এড়াতে চাইলে অল্প অল্প করে বার বার খাবার খান। অনেক সময় বেশি খাবার পাকস্থলী হজম করতে পারে না। অল্প পরিমাণ খাবার হজম করা সহজ হয়।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার:
অ্যাপেল সাইডার ভিনেগারের টক স্বাদ আপনার মুখে রুচি এনে দিতে পারে। এছাড়া এটি বুক জ্বালাপোড়া এবং গ্যাসের সমস্যা সমাধান করে। অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার পানির সাথে মিশিয়ে পান করবেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে পান করুন।
চলাফেরা করা:
অনেকেই গর্ভকালীন সময় হাঁটাচলা করা কমিয়ে দেন। এই কাজটি করা একদমই উচিত নয়। প্রতিদিন নিয়ম করে কমপক্ষে ৩০মিনিট হাঁটুন। এটি শুধুমাত্র খাবার হজমে সাহায্য করবে না, এরসাথে মাংসপেশী সচল রাখবে। অন্য যেকোন ব্যায়াম করার পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন:
স্বাভাবিক ওজনের একজন নারীর ওজন গর্ভাবস্থায় ১১.৫ কেজি–১৬ কেজি পর্যন্ত বাড়লে সেটিকে স্বাভাবিক ধরা হয়। তাই গর্ভকালীন সময়ে আপনার ওজন যাতে এর চেয়ে বেশি না বাড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখুন। অতিরিক্ত ওজনের কারণে বুক জ্বালাপোড়া হতে পারে।
ভাল করে চিবিয়ে খাবার খাওয়া:
খাবার আস্তে আস্তে এবং ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া উচিত। খাবার দ্রুত খাওয়ার ফলে হজমের সমস্যা হয়। যা গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালাপোড়া বাড়িয়ে দেয়।
কাঁচা কাঠবাদাম বুক জ্বালাপোড়া দূর করতে বেশ কার্যকর। কাঠবাদামে থাকা উপাদান পাকস্থলির গ্যাস হ্রাস করে বুক জ্বালাপোড়া রোধ করে।
খাবার শেষে বসা বা দাঁড়ানো:
খাবার খেয়ে সাথে সাথে শুয়ে পড়া উচিত নয়। বরং বসে বই পড়া,ঘরের ছোট ছোট কাজ গুলো করা,ধীরে ধীরে হাঁটা উচিত। আবার এমন কোন কাজ করা উচিত না যা নুয়ে বা ঝুঁকে করতে হয়। ঘুমাতে যাওয়ার দুই থেকে তিন ঘন্টা আগে খাবার খাওয়া উচিত।
মেথি:
এক গ্লাস পানিতে এক মুঠো মেথি সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। পরের দিন সকালে মেথি ফেলে দিয়ে পানি পান করুন। এটি গ্যাস কমিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে পেটের ব্যথা কমিয়ে দেয়।
ভাতের মাড়:
ভাতের মাড় আরেকটি সহজলভ্য উপাদান যা বুক জ্বালাপোড়া রোধ করে। এতে থাকা উপাদান পেটে গ্যাস জমে থাকা গ্যাস বের করে দেয়। নিয়মিত ভাতের মাড় পান করলে বুক জ্বালাপোড়া ভাব দূর হয়ে যায়।
বুক জ্বালাপোড়া অথবা গ্যাসের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অ্যালোভেরার জুস পান করতে পারেন। নিয়মিত অ্যালোভেরার জুস শুধু বুক জ্বালাপোড়া রোধ করে না এটি ত্বক ভিতর থেকে উজ্জ্বল করে থাকে। বাজারে নানা রকম অ্যালোভেরা জুস কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলোর পরিবর্তে নিজে ঘরে তৈরি করে নেওয়া বেশি নিরাপদ।
ডাবের পানি বদহজম দূর করে এবং শরীর থেকে টক্সিন পর্দাথ বের করে দেয়। এতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এবং মিনারেল রয়েছে। ডাবের পানি তাৎক্ষনিকভাবে বুক জ্বালাপোড়া ভাব দূর করে দেয়।
গাজর এবং পালং শাকের রস:
গাজর এবং পালং শাকের রস বুক জ্বালাপোড়া দূরে বেশ কার্যকর। সম অনুপাতে গাজর এবং পালং শাক একসাথে মিশিয়ে জুস তৈরি করে নিন। এটি প্রতিদিন পান করুন।
গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালাপোড়ার ঔষধ
সাধারণত ঘরোয়া সমাধানগুলো সঠিকভাবে মেনে চললে বুক জ্বালাপোড়া ও বদহজমের সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে এরপরও লক্ষণগুলো না কমলে ঔষধ খেতে পারেন।
1. প্রথমে অ্যান্টাসিড অথবা অ্যালজিনেট জাতীয় ঔষধ সেবন করতে পারেন। এই ধরনের ঔষধ সাধারণত বুক জ্বালাপোড়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পরে সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
2. যদি অ্যান্টাসিড অথবা অ্যালজিনেট সেবনের পরেও লক্ষণের কোনো উন্নতি না হয়, তাহলে এগুলোর পরিবর্তে ওমিপ্রাজল খেয়ে দেখতে পারেন।
গর্ভাবস্থায় সাধারণত অ্যান্টাসিড জাতীয় ঔষধ সেবন করা নিরাপদ৷ তবে কিছু অ্যান্টাসিড জাতীয় ঔষধ গর্ভের শিশুর ক্ষতি সাধন করতে পারে। গর্ভকালীন সময়ে এইসব নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টাসিড জাতীয় ঔষধ সেবন করা থেকে বিরত থাকবেন। যেমন-
1. বাইকার্বনেটযুক্ত অ্যান্টাসিড: গর্ভকালীন সময়ে বাইকার্বনেটযুক্ত অ্যান্টাসিড (যেমন: সোডিয়াম বাইকার্বনেট) সেবন করলে কিছু ক্ষেত্রে মা ও শিশুর শরীরে অতিরিক্ত পানি জমতে পারে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
2. ম্যাগনেশিয়াম ট্রাইসিলিকেটযুক্ত অ্যান্টাসিড: গর্ভাবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে এবং উচ্চ মাত্রায় ম্যাগনেশিয়াম ট্রাইসিলিকেটযুক্ত অ্যান্টাসিড সেবন করলে গর্ভের শিশুর শ্বাসকষ্ট ও কিডনিতে সমস্যা হতে পারে।
প্রতিরোধ
যদিও বুকজ্বালার সমস্যা বিপজ্জনক না এবং এটি চিকিৎসা ও পরিচালনাযোগ্য, এটি আটকানো যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় বদহজম কীভাবে এড়াবেন, তার জন্য এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেওয়া হল:
* ধূমপান করবেন না – সিগারেটগুলি গর্ভাবস্থায় প্রধান জটিলতা সৃষ্টি করে। এগুলি বুকজ্বালার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হিসাবে পরিচিত। এর কারণ হল নিকোটিন অতিরিক্ত পাকস্থলীর অ্যাসিড তৈরি হতে পারে।
* আপনার ডায়েট পরিবর্তন করুন – ঘন ঘন অল্প করে খাবার খান এবং নিশ্চিত করুন যে এই খাবার পুষ্টিকর হয় এবং এতে প্রচুর ফল ও সবজি থাকে। তৈলাক্ত খাবার এবং এমন খাবার যা পেট খারাপ করে তুলতে পারে, যেমন কার্বনেটেড পানীয়, মশালযুক্ত খাবার ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। আপনার ডায়েট বুকজ্বালার প্রধান কারণ হতে পারে; এই ব্যবস্থাপনা গর্ভাবস্থায় বুকজ্বালা এড়াতে সাহায্য করতে পারে।
* পোশাকও প্রভাব ফেলে – আরামদায়ক জামাকাপড় পড়ুন। খুব টাইট কিছু পোশাক পেটে অবাঞ্ছিত চাপ দিতে পারে এবং পাকস্থলীর অ্যাসিডে জোর দিতে পারে। এটি একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।
* হাইড্রেট – ভালভাবে হাইড্রেটেড থাকা আপনার শরীরের হজম নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে এবং অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে জমিয়ে দিয়ে প্রবাহিত করা কঠিন করে তোলে।
তথ্যসূত্র: shohay.health