
হাত পা ঘামা থেকে মুক্তির উপায়
অতিরিক্ত ঘাম কোনো জটিল সমস্যা নয়, সাধারণ একটি সমস্যা। এই অতিরিক্ত ঘাম সাধারণত হাতের তালু, পায়ের পাতা ও বগল থেকে হয়ে থাকে। শুধু গরমকাল নয়, কনকনে শীতেও হাতের তালু ঘামে ভিজে একাকার হয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার সময়ও হাত-পা ঘামতে পারে।
সমস্যা কেবল হাত মেলানোতেই সীমাবদ্ধ থাকে না; কম্পিউটারে টাইপ করতে গেলে, কলম দিয়ে কিছু লিখতে গেলে অথবা প্রয়োজনীয় কোনো কাগজ আপনি ধরেছেন মানেই সেটা আপনার হাতের ঘামে ভিজে খারাপ অবস্থা তৈরি হয়।
আবার পায়ের তালুও অতিরিক্ত ঘেমে যায়। এই কারণে সৃষ্টি হতে পারে দুর্গন্ধ। ফলে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। যেমন- জুতা পায়ে থেকে খুললেই আশেপাশের মানুষজন কমতে শুরু করে অথবা তাদের নাকটা আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই যতক্ষণ জুতা পায়ে আছে, ঠিক আছে।
হাত- পা ঘামার কারন
শরীরে এমন কিছু ত্বকজনিত সমস্যা বা রোগ রয়েছে যা ভুক্তভোগি রোগিরা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু যাদের এই সমস্যাটি রয়েছে তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। চর্মজনিত এই সমস্যাটি হলো হাত, পা ও হাতের তালুতে অতিরিক্ত ঘাম ঝড়া । এর কিছু কারনও রয়েছে। যেমন -
১. অজ্ঞাত- বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ২. বংশগত ৩. রাগ, ভয়, দূশ্চিন্তা ৪. হাত ও পায়ে ব্যাকটেরিয়া বা ফাংগাল ইনফেকশন ৫. হরমোনের সমস্যা- ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, রজ:নিবৃত্তি ৬. বিপাক ক্রিয়ার সমস্যা ৭. ক্যানসার জনিত সমস্যা-লিম্ফোমা, ফিওক্রোমোসাইটোমা ৮. অটো ইমিউন- রিউমাটয়েড আর্থাইটিস, এসএলই ইত্যাদি। ৯.কিছু কিছু ঔষধ।
চিকিৎসা
উপরোক্ত চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে অত্যাধুনিক আয়োনটোফরেসিস চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়োনটোফরেসিস হাত ও পা ঘামার সব চেয়ে কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। ১৭০০ সাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে আসছে। যদিও ১৯৪০ সাল থেকে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে একটি মেসিন থাকে, যেটি দূর্বল বিদ্যুৎ তৈরী করে। এই বিদ্যুৎ তারের মাধ্যমে ৪ টি স্টেইনলেস স্টিলের প্লেটে প্রবাহিত হয়। প্লেটের উপর ভিজা টাওয়েল থাকে। রোগী ভিজা টাওয়েলের উপর হাত ও পা রাখে। একটি সেসনে সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগে। ভালো হওয়ার আগ পর্যন্ত; সপ্তাহে সাধারণত ৩ দিন এই চিকিৎসা নিতে হয়। একবার ভালো হলে সাধারণত অনেক দিন পর্যন্ত রোগীর হাত ও পা ঘামা বন্ধ থাকে।
হাত পা ঘামা থেকে মুক্তির উপায়
হাত-পা ঘামার প্রতিকার হিসেবে নিচের প্রাকৃতিক এবং ঘরোয়া ঔষধগুলো নিয়মিত ব্যবহার করলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
১। বেকিং সোডাঃ ক্ষারধর্মী উপদান থাকার কারনলে বেকিং সোডা হাত পায়ের ঘাম প্রতিকারে অনেক কার্যকরী। ৩ টেবিল চামচ বেকিং সোডা গরম পানির সাথে মেশান। ৩০ মিনিট সেই পানিতে হাত পা ভিজিয়ে রাখুন এবং সে অবস্থায় ভাল করে ঘষুন। এরপর শুকনা কাপড় দিয়ে হাত পা মুছে ফেলুন।
২। আপেল সিডার ভিনেগারঃ সিরকা বা আপেল সিডার ভিনেগার হাত-পা ঘামার ঔষধ হিসেবে অনেক ফলপ্রসূ। এতে এস্ট্রিনজেন্ট নামক একধরনের পদার্থ আছে যা লোমকূপকে সঙ্কুচিত করে অতিরিক্ত ঘামাকে নিয়ন্ত্রণ করে। হালকা গরম পানি দিয়ে ঘর্মাক্ত স্থানগুলো ভিজিয়ে নিন। তারপর কটন বলের সাথে কিছু ভিনেগার লাগিয়ে নিন। সারারাত এভাবে রাখুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্থানগুলো ধুয়ে ফেলুন এবং সেখানে বেবি পাউডার লাগান। অথবা ভিনেগারের সাথে গোলাপজল মিশিয়ে দিনে দুই তিনবার লাগাতে পারেন। ভিনেগারের সাথে মধু মিশিয়েও লাগানো যাবে।
৩। ভুট্টার আটাঃ হাত পা ঘামার প্রতিকারে ভুট্টার আটা আরেকটি কার্যকরী ঔষধ। এটা হাইপারহাইড্রোসিসের প্রভাব কমিয়ে ত্বকের আর্দ্রতা শুষে নেয়। আর এটা ঘুব সহজে এবং অল্প টাকায় সব জাগায় পাওয়া যায়। সমপরিমাণ ভুট্টার আটার সাথে বেকিং সোডা মিশিয়ে ট্যালকম পাউডারের বোটলে ভরে রাখুন। টিস্যু দিয়ে অতিরিক্ত ঘর্মাক্ত জায়গাগুলো পরিষ্কার করুন এবং সেখানে পাঊডারের মত করে ব্যবহার করুন।
৪। লেবুর রসঃ লেবুর রসে প্রাকৃতিক ডিউডরান্ট বা গন্ধনাশক আছে যা, হাত ঘামার বন্ধ করাসহ এতে সৃষ্ট দুর্গন্ধও দূর করতে সক্ষম। ১টি লেবুর রসের সাথে বেকিং সোডা মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এরপর সেটা ঘর্মাক্ত জায়াগায় লাগিয়ে ১০ মিনিট রাখুন। অথবা লেবুর রসের সাথে পানি মিশিয়ে নিন। একটি পরিষ্কার কাপড় সেই পানিতে ভিজিয়ে সারা শরীর মুছুন। ২০ মিনিট পর গোসল করুন।
৫। টমেটোঃ টমেটোতে থাকা এস্টিনজেন্ট এবং কোষ ঠান্ডা রাখার উপাদান হাত পা ঘামা প্রতিকার করতে সাহায্য করে। এটা অতিরিক্ত ঘামার গ্রন্থিগুলোকে বন্ধ করে লোমকূপকে সঙ্কুচিত করে। এটা শরীরের তাপমাত্রাকেও কমিয়ে ফেলে। ১টি টমেটো কেটে ঘর্মাক্ত জায়গায় ঘষুন। অথবা টমেটো রস করে সেই জায়গাগুলোতে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট রাখুন। এতপর কুসুমগরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। দিনে একবার করে এটা করুন।
৬। ব্ল্যাক টি বা কালো চাঃ চায়ে এস্ট্রিনজেন্ট এবং আন্টিপারস্পিরান্ট আছে যা অতিরিক্ত তেল শুষে নিতে পারে। এটা হাত পা ঘামার প্রতিষেধক হিসেবে খুব কার্যকরী। ১ টি ব্ল্যাক টি ব্যাগ ঘাম শুষে নিতে ৫ মিনিট হাতের তালুতে ধরে রাখুন। অথবা একটা ছড়ানো পাত্রে কাল চা বানিয়ে ঠান্ডা করে নিন। এরপর ৩০ মিনিট হাত পা ভিজিয়ে রাখুন। এটা দিনে দুইবার করতে পারেন। দিনে ২-৩ কাপ ব্ল্যাক টি খেতে ভুলবেন না।
৭। উচ্চ ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত খাবারঃ হাত পা ঘামার অন্যতম একটি কারণ হল শরীর থেকে ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়া। ম্যাগনেসিয়াম লালাগ্রন্থি নিয়ন্ত্রণে এবং অতিরিক্ত ঘামা প্রতিকারে সাহায্য করে। তবে প্রথমে আপনার শরীরের ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ পরীক্ষা করে নিতে হবে। এটা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয় তাহলে প্রচুর ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার খান। উচ্চ ম্যাগনেসিয়াম যুক্ত খাবারগুলো হল, কাঠবাদাম, এভকাডো, শিম, মিষ্টিকুমড়ার বিচি, গুড়, কাজুবাদাম, বাদাম, আলু, দই, সবুজ শাক, ইত্যাদি।
৮। কাঠকয়লাঃ শুনতে অদ্ভুত লাগলেও পোড়ানো কাঠকয়লা হাত পায়ের ঘাম সমাধানে দারুণ কার্যকরী। এটা ত্বকে আদ্রতাভাব দূর করে। অনেক ত্বক যত্নের পণ্যতে এটা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে একগ্লাস গরম পানর সাথে ১ চা চামচ কাঠকায়লার ছাই খেয়ে নিন। এতে যদি পেট ব্যাথা বা বমি হয় তাহলে খালি পেটে খাবেন না।
৯। আলুঃ আলু অতিরিত ঘাম দূর করতে খুবই উপকারি সবজি। কয়েকটি আলুর টুকরো নিয়ে হাত পায়ের তালুতে ৫-৭ মিনিট ঘষতে থাকুন। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত পা ধুয়ে মুছে ফেলুন। এছাড়া আলুর রসও খেতে পারেন।
১০। গম গাছের সবুজ পাতাঃ গমের সবুজ পাতা শরীর থেকে জীবাণু ও ক্ষতিকর এসিড দূর করতে সাহায্য করে। এটা প্রাকৃতিক উপায়ে ব্যাকটেরিয়াকে তরল করে ফেলে। ফলে হাত পা ঘামার প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। দিনে ৩-৪ গ্লাস এই রস পান করতে পারেন।