তুরস্কের রাজনৈতিক ইতিহাস - Political history of Turkey
তুরস্কের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস? বিশ্বের সব রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে তুরস্ককে খুঁজে পাওয়া যাবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে সমানভাবে সক্রিয়। ঐতিহ্যবাহী ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর শক্তিশালী দেশ ও জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পশ্চিম সীমান্তে গ্রিস এবং পূর্ব সীমান্তে ইরানকে নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের সংযোগস্থলে আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১ম বিশ্ব যুদ্ধের পর কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে নতুনভাবে গড়ে উঠে তুরস্ক। সেই তুরস্ক ছিল প্রচন্ড পশ্চিমাঘেঁষা ও সেক্যুলারিজমে ভরপুর একটি রাষ্ট্র। তখন তুরস্কের নতুন এই যাত্রাকে পশ্চিমা দেশগুলো স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু ওসমানীয়দের ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসলামী শাসন এবং রীতিনীতি যে একেবারেই মুছে যায়নি, বিশ্ববাসীর কাছে এখন তা কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে।
২০০২ সাল থেকে রজব তাইয়েব এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল তুরস্কের ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯২৩ সালে আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের তত্ত্বাবধানেই দেশটিতে বেশ বড় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এরদোয়ান সেক্যুলার তুরস্কের শরীরে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এখন তার ইশারায় অনেক সমীকরণ বদলে যাচ্ছে । তিনি যে পুরোদস্তুর ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসী সেগুলো এখন আরো প্রকাশ্যভাবে সামনে আসছে। অনেকে বলছেন, এরদোয়ান তার ভাটা জনপ্রিয়তায় জোয়ার আনতে হায়া সোফিয়া জাদুঘরকে আবারও মসজিদে রূপান্তর করেছেন। পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই তাকে স্বৈরশাসক তকমা দিয়ে থাকেন। ২০১৬ সালের এই জুলাই মাসেই সেনাবাহিনীতে এরদোয়ানবিরোধী এক অভ্যুত্থানের ঘটনা আমাদের সবার মনে থাকার কথা। তুরস্ক ওই ক্যুর জন্য আমেরিকায় অবস্থিত ফেতুল্লা গুলেনকে দায়ী করে থাকেন। অন্তরালে তুরস্ক অভ্যুত্থানের দায় যুক্তরাষ্ট্রকেই দিতে চায়। এ ক্ষেত্রে এরদোয়ান ও নতুন তুরস্কের কর্মকান্ডে পশ্চিমা শক্তির হয়েছে আরেক বিপদ। নব্য এই তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যভাবে পারছে না তারা ব্যবস্থা নিতে আবার সম্পূর্ণভাবে পাশে থাকতেও পারছে না?
এরদোয়ান তার বিরুদ্ধে সংঘটিত সেনাবাহিনীর ক্যু শুধু দমন করেই ক্ষান্ত হননি তিনি তার সেনাবাহিনীকে আরো আধুনিকায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তুরস্কের সেনাবাহিনী তার দেশের রাজনীতির জন্য একটা বড় বিষয়। ১৯৬০, ১৯৭১ ও ১৯৮০ সালে তুরস্কের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী দেশটির সরকারকে উৎখাত করেছিল। সম্প্রতি তুরস্ক ড্রোন প্রযুক্তি ও মিসাইল তৈরির সক্ষমতা বাড়িয়েছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরির বিষয়েও তার চিন্তাভাবনা রয়েছে। গত বছরের এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকটি দেশের পারমাণবিক ওয়ারহেডসহ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। কিন্তু আমাদের সেটা নেই। আমি এটা মানতে পারছি না। বিশ্বে এমন কোনো উন্নত দেশ নেই, যারা এই অস্ত্রের মালিক না।’ এরদোয়ানের এই বক্তব্যের পর গোটা বিশ্ব পরিষ্কার যে, তুরস্ক সুযোগ পেলে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে। কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক বর্তমান সময়ে বেশ চোখে পড়ার মতো। মালয়েশিয়ার নেতা মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গেও বোঝাপড়া ভালোই। কূটনৈতিকভাবে এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে চলা । এমনকি এই করোনা পরিস্থিতিতেও এরদোয়ান ইসরায়েলে চিকিৎসাসামগ্রী পাঠিয়েছেন। বিখ্যাত আয়া সোফিয়া মসজিদে পুনরায় আজান দিয়ে তিনি সুলতান খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। নির্মাণ করেছেন এক হাজার রুমবিশিষ্ট নতুন প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস ‘হোয়াইট প্যালেস’। এটাকে অনেকেই তার সুলতান হওয়ার বাসনার ফল হিসেবে দেখছেন। মুসলিম বিশ্বে এখন আর কোনো শাসক নেই যিনি এমন প্রাসাদ থেকে রাজ্য পরিচালনা করছেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা মিত্রকেও হারাতে পারে তুরস্ক। হায়া সোফিয়া মসজিদ নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ গ্রিস তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। খোদ পোপ বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এখন এই পরিস্থিতিতে কি ইসলামী ভাবধারার নতুন এই তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক তেতে উঠবে? আমার মতে, পশ্চিমারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে কিছু বলবে না। ১৯৫২ সালে প্রতিবেশী গ্রিসের সঙ্গে তুরস্ক ন্যাটো জোটে যোগ দেয়। দেশকে ধীরে ধীরে ইসলামীকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং তুরস্কের পশ্চিমাঘেষা রীতিনীতি পরিবর্তনের জন্য সমালোচকরা এরদোয়ানকে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু ন্যাটোর সদস্য হিসেবে সেক্যুলার রাষ্ট্র পরিচয় মুছতেও তিনি নারাজ। কাশ্মীর ইস্যুতে কিছুটা পাকিস্তানের পক্ষে কথা বললেও ভারত সফরের সময় এই বিষয়ে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিপক্ষে কথা বলেছেন। উইঘুরদের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠ তাকে মুসলিম বিশ্বের জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলেছে। তবু কিছু মুসলিম দেশ তার আচরণে অসন্তুষ্ট।
এরদোয়ানের মস্তিষ্ক যে, তুর্কিদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে কাজ করছে, তা অনেকটা পরিষ্কার। তুর্কিরা অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি। ঐতিহাসিকভাবে তুর্কি সাম্রাজ্য বা অটোমান সাম্রাজ্য ছিল একটি ইসলামী সাম্রাজ্য। প্রথম ওসমানের পিতা আরতুগ্রুল গাজী ছিলেন প্রকৃত অর্থে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম ওসমান ১২৯৯ সালে সেলযুক সাম্রাজ্য কর্তৃক উত্তর-পশ্চিম আনাতোলিয়ার দায়িত্ব পান। তিনি সেলযুক সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকলেও সাম্রাজ্যের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। ওসমানীয় সাম্রাজ্য সুদীর্ঘ ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে দীর্ঘদিনব্যাপী ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে তারা। ধারাবাহিক অবনতির ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর আনাতোলিয়ায় নতুন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক তুরস্কের উদ্ভব হয়। তুরস্কের বর্তমান শাসক এরদোয়ান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম শাসকদের মতো নন। তার দল একে পার্টি প্রকাশ্যে ইসলামী দল না হলেও তাদের মূল চরিত্র বা চালিকাশক্তি ইসলামী রাজনীতি। এরদোয়ান ছাত্রজীবন থেকেই এই রাজনীতির অংশ। সুতরাং সৌদি আরব, কাতার ও আমিরাতের শাসকদের মতো ভোগবিলাস বা সম্পদের প্রাচুর্যে বিভোর থাকার চেয়ে বরং তার কাছে অতীত ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ। মোদ্দাকথা বলতে গেলে এরদোয়ান ঠিক সেই পথেই হাঁটছেন। আর্তুগ্রুল গাজীকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে মেগা সিরিজি ‘দিরিলিস : আরতুগ্রুল বা পুনরুত্থান: আরতুগ্রুল’ । ইতোমধ্যে মিসর, সৌদি আরবসহ অনেকগুলো দেশ এই টিভি সিরিজটি নিষিদ্ধ করেছে। মিসরের শরিয়াহ বোর্ড সিরিজটিকে তাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তুরস্ক সাংস্কৃতিক, সামরিক, কূটনৈতিক ও গণমাধ্যমের দিক দিয়ে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে টেলিভিশন নেটওয়ার্কের বলয়ে মুসলমানদের কাছে পৌঁছাতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ‘টিআরটি’ নামক নিউজ নেটওয়ার্ক। হলিউডের এক্সপেন্ডিবলস ২, রোনিন ও কোনান দ্য বারবারিয়ানের মতো চলচ্চিত্রের কোরিওগ্রাফার টিমকে তুরস্কে আমন্ত্রণ জানিয়ে তৈরি করা হচ্ছে টিভি সিরিজ। কূটনৈতিকভাবেও মুসলমানদের নিয়ে চলছে অ্যালায়েন্স গঠনের পরিকল্পনা। এরদোয়ান মুসলমানদের আবেগের জায়গা বায়তুল মোকাদ্দাস নিয়েও আশার বাণী শোনাচ্ছেন ।
স্থানীয়ভাবে এরদোয়ান নিজ দেশের সীমানার বাইরে সিরিয়ার একটি বিরাট অঞ্চল দখলে রেখেছেন। সিরিয়া ছাড়াও লিবিয়া ও কাতারে তুর্কি সেনা রয়েছে। গ্রিসের প্রভাব কমাতে লিবিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে তুরস্ক। খনিজ সম্পদ আহরণের নামে তুরস্ক সাইপ্রাসেও উপস্থিতি নিশ্চিতের চেষ্টা করছে। আফ্রিকায় ইতোমধ্যে নিজেদের বেশ প্রভাবশালী জায়গায় নিয়ে গেছে তুরস্ক। এরদোয়ান যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত সোমালিয়া ভ্রমণ করেন ২০১১ সালে। সেখানে সহায়তার নামে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন এরদোয়ান। তবে এরদোয়ানের বাসনা পূর্ণ হওয়ার সবচেয়ে বড় বাধা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের বিশ্বপরিস্থিতি বদলে যায়। দুনিয়ার কর্তা হয়ে ওঠে পাঁচ মোড়ল বা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স। ফলে বিশ্বের বড় বড় সব সিদ্ধান্ত নেন এই দেশগুলো। এখানে তুরস্কের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। ফলে এখানেও পরিবর্তন চান এরদোয়ান। গত বছর জাতিসংঘে আফ্রিকান বিজনেস ফোরামে তিনি একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ওয়ার্ল্ড ইজ গ্রেটার দ্যান ফাইভ’। এর আগেও তুরস্ক প্রায় এক দশক ধরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠনের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করেছে।
কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক থেকে এরদোয়ান তার তুরস্ককে ইসলামিক ভাবধারা ও ওসমানীয় খেলাফতের দিকে অধিক ধাবিত করেছেন। এরদোয়ান এখন হোয়াইট প্যালেসে বসে চাচ্ছেন পূর্বেকার তুর্কিদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে। তবে বর্তমান দুনিয়ার বাস্তবতায় নতুন কোনো ওসমানীয় সাম্রাজ্য গড়া অসম্ভব হলেও হয়তো নতুনভাবে নতুন পরিস্থিতির সুলতান হওয়া সম্ভব। এরদোয়ান তুরস্ককে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে নিয়ে নিজেকে সুলতানের আসনে বসাতে পারেন। ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনতো পাবেনই না, তবে নিজেদেরে ডেরা মধ্যপ্রাচ্যেই প্রবল বাধার মুখে পড়বেন তিনি। মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরব আর তার বিকল্প কোনো শক্তির উত্থানকে মেনে নেবে বলে ইতিহাস সায় দেয় না। ওদিকে ইসরায়েল তার প্রভাবিত বলয় নিয়ে নতুন এই তুরস্কের বিরোধিতা করবে এটা বিনা বাক্যেই বলা যায়। এতসব বাধাবিপত্তির পর ওসমানীয় সাম্রাজ্য নিয়ে এরদোয়ানের নস্টালজিয়া আচরণ, ইসলামী ভাবধারায় আবার তুরস্ককে পরিচালিত করা এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে এরদোয়ানের তৎপরতা কতটুকু সামনের দিকে এগোবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।