ইন্ট্রোভার্ট ও লাজুক | আপনি আসলে কোনটি?
ইন্ট্রোভার্ট কিংবা অন্তর্মুখী মানুষ হচ্ছে তারা, যারা নিজেদের মতো থাকতে ভালোবাসেন। ভিড় এবং আড্ডার আসরে তাদের খুব একটা পাওয়া যায় না। এরা নিরিবিলি নিজেদের সময় দিতেই ভালোবাসেন। আর তাদের এই আচরণের জন্য অনেকেই তাদের অসামাজিক বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার মানে হলো বিশৃঙ্ক্ষলা, মানুষের কথার আঘাত, নানা নিষ্ঠুরতা থেকে দূরে থাকতে পারা। যত একা থাকবেন, ততই এসব থেকে দূরে থাকতে পারবেন। শুনতে সুখকর মনে হলেও ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার সুবিধার পাশাপাশি আছে অসুবিধাও। এতে অনেক সুযোগ হারাতে হতে পারে যা অন্যরা দ্রুতই পেয়ে যায়। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক ইন্ট্রোভার্ট সম্পর্কে-
ইন্ট্রোভার্ট বলতে কি বুঝায়?
ইন্ট্রোভার্ট শব্দের অর্থ অন্তর্মুখী। ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি লাজুক হতে পারেন, কিন্তু এই বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি লাজুকতা নয়। আমাদের মাঝে মাত্র ২৫-৪০ ভাগ মানুষ ইন্ট্রোভার্ট, তবে প্রকৃতি প্রদত্ত বিশেষ গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ, যাদের আমরা বলে থাকি ‘গিফটেড পারসন’, তাদের ৬০ ভাগই ইন্ট্রোভার্ট হয়ে থাকেন।
ইন্ট্রোভার্ট ও লাজুক কি আসলে একই?
যারা ইন্ট্রোভার্ট তারা চিন্তা করা, নিজেদের চিন্তা-ভাবনা ও অনুভূতিতে বিচরণ করতে ভালোবাসেন। এর মানে তারা লাজুক না। ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা অনেকেই ভুল জানি। আমরা ভাবি, তারা মানুষের সাথে মিশতে পারে না বা মিশতে পছন্দ করে না, সবার সাথে সময় কাটাতে চায় না ইত্যাদি। কিন্তু অন্যদের মতোই ইন্ট্রোভার্ট মানুষও তাদের পছন্দের মানুষ বা সার্কেলের সাথে থাকতে, কথা বলতে ভালোবাসে। ইন্ট্রোভার্টরা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে গসিপ করার চেয়ে কোন আইডিয়া বা চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলে থাকে। ইন্ট্রোভার্টদের অনেকেই আছেন, যারা পার্টিতে যাবার চেয়ে ঘরে বসে বই পড়তেই বেশি পছন্দ করেন।
আবার অনেক ইন্ট্রোভার্ট আছেন, যাদের সামাজিক অনুষ্ঠানই বেশি পছন্দ। আপনি নিজেও হয়তো জানবেন না, আপনার সামনের হাসিখুশি সদালাপী মানুষটি আসলে ইন্ট্রোভার্ট। সত্যি কথা বলতে, ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তিদের সামাজিক দক্ষতা অনেক ভালো হতেই পারে, কিন্তু সেটা আমাদের চোখে পড়ে কম। তার প্রধান কারণ হলো, সামাজিক অনুষ্ঠান বা লোকসমাগমে সময় ব্যয় করার চেয়ে তারা নিজেদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সময় ব্যয় করতে বেশি পছন্দ করে। এমনও হয়, কোন ইন্ট্রোভার্ট ব্যক্তি হয়তো কোন পার্টিতে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছেন, সবার সাথে কথা বলেছেন, কিন্তু একটা সময় তার নিজেকে নিজের সময় দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই সময়টা তাদের জন্য ‘রিচার্জ’ হবার সময়। প্রয়োজন মতো এই সময় না পেলেই তারা একটু একা থাকতে চায়। এক্সট্রোভার্টদের সাথে ইন্ট্রোভার্টদের মূল পার্থক্য এখানেই।
আপনিও কি ইন্ট্রোভার্ট?
আপনি কি কখনো অনেক মানুষের সাথে সময় কাটাবার পর ক্লান্ত বোধ করেন? আপনি অফিসে গেলেন, সবার সাথে কথা বললেন, কিংবা অনেকে মিলে বেড়াতে গেলেন, সবাই মিলে আড্ডা দিলেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আপনি যদি এতে হাঁপিয়ে ওঠেন, তবে আপনি সম্ভবত ইন্ট্রোভার্ট। ইন্ট্রোভার্ট হবার একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সামাজিক ব্যাপারগুলোতে আপনার মনে হবে আপনি সময় বা শক্তি খরচ করছেন, যেখানে অন্যরা বরং এসব উপভোগ করে।
বিকালবেলা বা অবসরে আড্ডা দেবার চেয়ে বা বন্ধুরা মিলে কোথাও ঘুরতে যাবার চেয়ে আপনি যদি একা একটু বই পড়া, নিজের শখের কাজগুলো করা, গান শোনা বা টিভি দেখাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তবে আপনি সম্ভবত ইন্ট্রোভার্ট। মনে রাখবেন, অনেক ইন্ট্রোভার্ট এর বিপরীতও করে থাকেন।
অন্যরা কি আপনাকে রিজার্ভড, চুপচাপ স্বভাবের বলে জানে? ইন্ট্রোভার্টদের অন্যরা রিজার্ভড, চুপচাপ এমনকি ভুল করে অনেক সময়ই লাজুক বলে থাকে। আসল ব্যাপার হলো, ইন্ট্রোভার্টরা কথা বলার আগে সেটা ভালোমতো ভেবে দেখে, তাই রেসপন্স করতে একটু সময় নেয়। তাছাড়া অধিকাংশ ইন্ট্রোভার্ট অযথা কথা বলতে পছন্দ করে না।
ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার অসুবিধা
অন্যরা আপনাকে অদ্ভুত মনে করে
আপনি যদি নিজের সঙ্গই বেশি পছন্দ করেন এবং অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে থাকেন তাহলে মানুষ আপনাকে অদ্ভুত ভাবতে শুরু করবে। যারা অন্যদের সঙ্গে মেশে না বা কম মেশে তাকে বাকিরা বেশিরভাগ সময়েই সন্দেহজনক মনে করে। কেউ কেউ আবার অবজ্ঞাও করতে পারে।
আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না
পেশাগত জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যোগাযোগ বা নেটওয়ার্কিং। আপনি যত বেশি নেটওয়ার্কিং করবেন তত বেশি মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবেন। যারা পরবর্তীতে আপনাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু যখন আপনি চুপচাপ থাকেন বা অন্যদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলেন না তখন এ ধরনের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। অন্যরাও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পছন্দ করে না।
আপনার প্রতিভা অন্যদের চোখে পড়ে না
যতই মেধাবী আর প্রতিভাবান হোন না কেন, আপনার ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের জন্য তা অন্যদের চোখে পড়বে না। আপনি কতটা প্রতিভাবান তা অন্যদের বোঝানোর জন্য সামান্য হলেও চেষ্টা করতে হবে। আপনার কাজ ও মেধা অন্যদের নজরে আনার জন্য আপনার কোনো রকম প্রচেষ্টা না থাকলে কেউ আপনাকে খেয়াল করবে না।
প্রেমের অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না
ইন্ট্রোভার্ট মানুষের প্রেমের অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না। কারণ অন্যদের সঙ্গে মেশার মতো তাদের যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস থাকে না এবং সম্ভাব্য প্রেমিক/প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলার মতো দক্ষতাও থাকে না। এ ধরনের মানুষেরা বেশিরভাগ সময়েই প্রেমের জগতে তাল মেলাতে পারে না।
ভুল বোঝাবুঝির শিকার বেশি হয়
এ ধরনের মানুষকে অন্যরা ভুল বোঝে বেশি। অনেকে আবার নিজের ভুল শোধরানোর চেষ্টাও করে না। ইন্ট্রোভার্ট মানুষকে অন্যরা অসামাজিক, অনিরাপদ ভেবে ভুল করে। যদিও সবাই একইরকম হয় না। আপনার যদি সাহায্য করার মতো চমৎকার মানসিকতা থাকে তবে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে।
অন্তর্মুখী (Introvert) স্বভাবের মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য
১. বেশিরভাগ সময়েই ফেসবুকের চ্যাটলিস্ট (Active Status) বন্ধ রাখে।
২. ফেসবুকে অপেক্ষাকৃত কমপোস্ট আর শেয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
৩. বন্ধুত্বের সার্কেল মোটামুটি ২-৩জনের একটা গ্রুপ বা তারও কম।
৪. সরাসরি ফোনের কল রিসিভ না করে, রিং শেষের অপেক্ষায় থাকে, তারপর ছোট্ট একটা বার্তা পাঠায়, "কথা বলতে পারবোনা। কি ব্যাপার! অনুগ্রহপূর্বক মেসেজে বলুন"।
৫. নিজের সাথেই মনে মনে কথা বলতে পছন্দ করে।
৬. চারদেয়ালের ঘরোয়া পরিবেশটাই তার জন্য খোলা ময়দান।
৭. কেউ তাকে পছন্দের কথা জানালে, সে বলে, " এটা কীভাবে সম্ভব! আমার মতো মানুষকে কেউ পছন্দ করবে তা সম্পূর্ণ ধারণার বাইরে"।
৮. যদি কোনো সম্পর্কের মাঝে আবদ্ধ থাকে, তবে জীবনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ধরে রাখতে চায়।
৯. বেশিরভাগ মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে চোখ মেলানোয় অভ্যস্ত নয় সে।
১০. সে শরীরচর্চার চেয়ে বেশিরভাগ সময় সকালের প্রকৃতির ছোয়া পেতেই বাইরে যায়।
১১. হোয়াটসঅ্যাপে কোনো মেসেজের নোটিফিকেশন আসলে, এ্যাপে না ঢুকে সরিয়ে দেয় নোটিফিকেশন বার থেকে যদি না কোনো রিপ্লাই করার ইচ্ছে থাকে।
১২. সাইড পকেট আছে এমন পোশাক পড়তে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে, যাতে করে অস্বস্তিকর কোনো পরিস্থিতিতে হাত গুটিয়ে পকেটে নিতে পারে।
১৩. নিজের জন্মদিন নিয়ে অতটা হইচই, মাথাব্যথা নেই। সময় সুযোগ পেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিলেই বাঁচে!১৪. সে সপ্তাহান্তে ঘুরতে যায় না বরং বই পড়েই কাটায়।
১৫. তার ফ্যাশন, স্টাইল নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
১৬. তার হৃদয়ের কোনো এক কোণে নিরাপত্তাহীন একটা জায়গা আছে, তবে সেটা সুকৌশলে গোপন রাখতে জানে।
১৭. সে অলস নয়, তবে আগ্রহটাই কম।
১৮. সে কতটুকু প্রতিভার, সেটা শুধুই তার রুমের দেয়াল গুলোই জানে।
১৯. রুমের বাইরে পা রাখেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত না যে মেহমানরা (Guests) চলে গেছে।
২০. কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য, গাধামো আর যাইকরুক না কেন, তাদের উপরও তেমন কোনো ক্ষোভ নেই, যেমন অন্তর্মুখী আছে, তেমনই থেকে যায়।
২১. মনের মাঝেই একটা সাম্রাজ্য তৈরি করতে পারে, যেখানে সকল কথাবার্তা, যোগাযোগ, ছন্দ-কবিতা, গান, গল্প, আর কাল্পনিক চরিত্রের সৃষ্টি নিজে একা একাই করে, মনেহয় সেটাই তার বাস্তবতা।
২২. সে মনে করে এই জীবনের অর্থ-পরিধি আরও বিশাল যা স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়না। আর সেই জীবনের গভীর অর্থ খুঁজতেই সময় কাটে তার।
২৩. কথা কম, কাজ বেশি:বলা হয়, “Introverts are good listeners”তারা হয়তো কথা খুবই কম বলতে পছন্দ করে তবে তারা যেটা খুব ভালো পারে তা হল অপরের কথা মন দিয়ে শোনা।