রোজা ভঙ্গের কারণ কী কী? - What are the reasons for breaking the fast?
সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। ইসলাম ধর্মমতে, রোজা মুসলমানদের জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। বলা হয়েছে, ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা তৃতীয়।
ইসলামি শরিয়ামতে, সিয়ামের শুদ্ধতা ও যথার্থতার জন্য নির্ধারিত কিছু বিধিবিধান রয়েছে, যার ব্যতিক্রম ঘটলে রোজা ভঙ্গ হয়, অন্যথায় মাকরুহ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুমিন বান্দাকে রমজান মাসে ফরজ রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা রাখবে না বা ভঙ্গ করবে তার জন্য জান্নাতে প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ ও সবল মুমিনের জন্য রোজা রাখা আবশ্যক। শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই রোজা নয়; বরং রোজা রাখা অবস্থায় মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নিয়মও।
আবু হুরায়রা (রা.) জানান, মহানবী রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি (শরিয়ত অনুমোদিত) কোনো কারণ ছাড়া বা রোগ ছাড়া রমজান মাসের একটি রোজা ভেঙে ফেলেন তার পুরো জীবনের রোজা দিয়েও এর ক্ষতিপূরণ হবে না। যদিও সে জীবনভর রোজা রাখেন। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭২৩)।
কোরআনের এ নির্দেশ মনে রাখতে হবে
وَ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ فِیۡمَاۤ اَخۡطَاۡتُمۡ بِهٖ ۙ وَ لٰکِنۡ مَّا تَعَمَّدَتۡ قُلُوۡبُکُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا
'আর এ বিষয়ে তোমরা কোন ভুল করলে তোমাদের কোন পাপ নেই; কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে (পাপ হবে)। আর আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' (সুরা আহযাব : আয়াত ৫)
১. ইচ্ছাকৃত বমি করা বা মুখে বমি চলে আসার পর তা পরিমাণে অল্প হলেও ইচ্ছা করে গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে। (মুসলিম, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
২. কোনো কারণে নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে মুখে চলে আসলে রোজা ভেঙে যাবে।' (তাতারখানিয়া)
৩. মুখে পান বা অন্য কোনো খাবার রেখে ঘুমিয়ে পড়ার পর জেগে ওঠে যদি দেখে যে, সুবহে সাদেক হয়ে গেছে আর সেই পান বা খাবারের কিছু অংশ পেটে চলে যায়; তবে তার রোজা হবে না। পরে কাজা করতে হবে। তবে এ কারণে রোজা ভেঙে যাওয়ায় কাফফারা দিতে হবে না।' (শামি)
৪. ওজু করার সময় বা যে কোনো কারণে কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে পানি গলা দিয়ে পেটে চলে যায়, ওই ব্যক্তির রোজা হবে না। এ রোজা পরে কাজা করতে হবে। আর কুলি করার সময় যদি রোজার কথা স্মরণই না থাকে এবং পানি মুখে নিয়ে খেয়ে ফেলে তবে রোজা ভাঙবে না।' (তাতারখানিয়া)
৫. নাক ও কানে তেল দেওয়ার দ্বারাও রোজা ভেঙে যাবে। তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে না।' (হেদায়া)
৬. যদি কোনো ব্যক্তি কারো ধমকের (ভয়ে) কারণে কিংবা রোজা রাখার কথা ভুলে গিয়ে কোনো কিছু খেয়ে ফেলার পর (না জানার কারণে) রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত খাবার খেলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। পরে এ রোজা কাজা করা জরুরি। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
৭. পাথরের কণা, মাটি, ঘাস, কাগজ ইত্যাদি অর্থাৎ সাধারণত যা আহারযোগ্য নয় কিংবা যেসব খাবার মানুষের কোনো উপকারে আসে না তা খেলেও রোজা ভেঙে যাবে। আর এ রোজা পরে কাজা করতে হবে।' (বাযযাযিয়া)
৮. দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রী সহবাস করলে; এ সহবাসে বীর্যপাত হোক আর নাই হোক স্বামী-স্ত্রী উভয়ের রোজা ভেঙে যাবে। এই অবস্থায় রোজা ভঙের ৫ পরিণাম কবিরা গুনাহ হবে; ফলে তাদের তাওবা করতে হবে; রোজা বাতিল হয়ে যাবে; তাদের উভয়কে ওই দিনের অবশিষ্ট অংশ খাবার ও পাণীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে;
ওই দিনের রোজা (রমজানের পরে) কাজা করতে হবে; কাফ্ফারা আদায় করতে হবে। আর কাফ্ফারা হলো- একাধারে দুই মাস রোজা রাখা অথবা একজন গোলাম আজাদ করা কিংবা ৬০ জন মিসকিনকে একবেলা খাবার খাওয়ানো।
৯. সহবাস ছাড়া অন্য পন্থায় যৌনস্বাদ নেওয়ার জন্য বীর্যপাত ঘটালেও রোজা ভেঙে যাবে। এমনকি যদি কোনো রোজাদার যৌনস্বাদ নেওয়ার জন্য স্পর্শকাতর কোনো যুবতী যৌবনা নারী সংস্পর্শে আসে; তাকে চুম্বন করে; জড়িয়ে ধরে অথবা হস্তমৈথুন করে ইত্যাদির মাধ্যমে বীর্যপাত ঘটায় তবে তার রোজা ভেঙে যাবে।
(সবার জানা উচিত যে, এই কর্মগুলি যেমনিভাবে রোজার মাসে হারাম তেমনিভাবে অন্য সময়গুলোতেও হারাম।)
১০. উপকারি কিংবা অপকারি, কম কিংবা বেশি, হালাল কিংবা হারাম খাবার; যা-ই হোক তা দিনের বেলায় নাক-মুখ দিয়ে গ্রহণ করলেও রোজা ভেঙে যাবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'আর পানাহার কর; যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিস্কারভাবে দেখা যায়।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)
১১. এমনকি রোজাদার যদি খাবারের বিকল্প উপায় হিসেবে- রক্ত গ্রহণ; শক্তিবর্ধক স্যালাইন গ্রহণ; এমন ইঞ্জেকশন যা আহারের কাজ করে অর্থাৎ গ্লুকোজ ইনজেকশন ইত্যাদি গ্রহণ করে তবে রোজা ভেঙে যাবে।
১২. অসুস্থতার কারণে ইনহেলার (Inhelar) ব্যবহার করলেও রোজা ভেঙে যায়। (শামি)
১৩. কোনো রোজাদার নারীর যদি ইফতারের আগ মুহূর্তেও হায়েজ (মাসিক) ও নেফাস (প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ) হয়, তবে রোজা ভেঙে যাবে।
১৪. রোজাদার ব্যক্তির শরীর বা দেহ থেকে দুষিত রক্ত বের করলে রোজা নষ্ট হবে কি হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে; তবে মূল কথা হলো- দিনের বেলায় রোজা থাকা অবস্থায় কোনো রোজাদারের জন্যই এ কাজ না করা উত্তম।
১৫. কোনো রোজাদার যদি তার কোনো কথা, কাজের কারণে যদি মুরতাদ বা ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় (কাফের)।তবে ওলামায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে তার রোজা বাতিল হয়ে যাবে। অতপর সে যদি তাওবা করে পুনরায় মুসলিম হয়, তাহলে এ রোজা রমজানের পরে কাজা করতে হবে; (আল্লাহ এ ধরনের কথা ও কাজ থেকে হেফাজত করুন)
১৬. কোনো রোজাদার যদি ফজর থেকে নিয়ে মাগরিব পর্যন্ত বেহুশ থাকে, তবে তার রোজা শুদ্ধ হবে না। বরং তাকে ওই দিনের রোজা পরে কাজা করতে হবে।
১৭. রোজার নিয়তে গরমিল হলেও রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। নিয়ত প্রত্যেক ইবাদত তথা রোজার অন্যতম রোকন। আর সারাদিন সে নিয়ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে মনে জাগ্রত রাখতে হবে যে, আমি রোজাদার। যাতে রোজাদারের নিয়তে রাখা না রাখার বা রোজা বাতিল করার কোনো দৃঢ় সংকল্প না করে বসে।
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয়
*বিনা ওজরে কোনো জিনিস মুখে দিয়ে চিবানো।
*গরমের কারণে বারবার কুলি করা।
*টুথ পাউডার, পেস্ট, কয়লা বা অন্য কোনো মাজন দ্বারা রোজার দিনে দাঁত পরিষ্কার করা।
*বিনা ওজরে জিহ্বা দ্বারা কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করা। তবে বদমেজাজি স্বামীর জন্য স্ত্রীর তরকারির স্বাদ গ্রহণ করার অনুমতি আছে।
*রোজাদার অবস্থায় কারও গিবত (পরচর্চা, পরনিন্দা) করা।
*মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।
*অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করা কিংবা পাঠ করা।
*ঝগড়া-বিবাদ করা।
রোজার কাজা ও কাফফারা কী?
রোজার কাজা হলো ভেঙে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা রোজার প্রতিবিধান হিসেবে শুধু রোজা আদায় করা। অতিরিক্ত কিছু আদায় না করা। অন্যদিকে রোজার কাফফারা হলো প্রতিবিধান হিসেবে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা।
রোজার কাফফারা বিষয়ে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার কী হয়েছে? সে বলল, আমি রোজা অবস্থায় আমার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, স্বাধীন করার মতো কোনো ক্রীতদাস তুমি মুক্ত করতে পারবে কি? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি একাধারে দুই মাস সাওম পালন করতে পারবে? সে বলল, না। এরপর তিনি বললেন, ৬০ জন মিসকিন খাওয়াতে পারবে কি? সে বলল, না।
হাদিস বর্ণনাকারী বলেন, তখন নবী (সা.) থেমে গেলেন, আমরাও এ অবস্থায় ছিলাম। এ সময় নবী (সা.)-এর কাছে এক ‘আরাক পেশ করা হলো যাতে খেজুর ছিল। আরাক হলো ঝুড়ি। নবী (সা.) বললেন, প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, আমি। তিনি বললেন, এগুলো নিয়ে দান করে দাও। তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমার চেয়েও বেশি অভাবগ্রস্তকে সাদকা করব? আল্লাহর শপথ, মদিনার উভয় প্রান্তের মধ্যে আমার পরিবারের চেয়ে অভাবগ্রস্ত কেউ নেই। রাসুল (সা.) হেসে উঠলেন এবং তাঁর দাঁত দেখা গেল। অতঃপর তিনি বললেন, এগুলো তোমার পরিবারকে খাওয়াও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৩৬)।
বেশির ভাগ ফকিহ বলেন, হাদিসে বর্ণিত ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আবশ্যক। অর্থাৎ রোজা ভঙ্গকারী দাস মুক্ত করতে অক্ষম হলে দুই মাস রোজা রাখবে। আর দুই মাস রোজা রাখতে ব্যর্থ হলে ৬০ জন মিসকিনকে খাবার খাওয়াবে।
অর্থাৎ কাফফারার জন্য বিরতিহীন দু’মাস (৬০টি) রোজা রাখতে হবে। দু’মাসের মধ্যে যদি কোনো একদিন রোজা ভাঙ্গে, তবে আবার একাধারে দু’মাস রোজা রাখতে হবে। আগের রোজা বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে নারীদের হায়েজ শুরু হলে আগের রোজা বাতিল হবে না। পাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার রোজা শুরু করতে হবে এবং ৬০টি রোজা রাখতে হবে।
রোজা রাখার শক্তি না থাকলে ৬০ জন মিসকিনকে দু’বেলা বা এক জনকে ৬০ দিন দু’বেলা করে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়াতে হবে কিংবা ৬০ জন মিসকিনের প্রত্যেককে একটি করে সদকায়ে ফিতরের মূল্য দেবে।