আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা-Al-Jamiatul Ahlia Darul Uloom Mueenul Islam Madrasa
আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম, বা হাটহাজারী মাদ্রাসা বাংলাদেশের একটি কওমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচী দ্বারা শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম শিক্ষার অন্যতম একটি অরাজনৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । এটি বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহের উম্মুল মাদারিস তথা কওমি মাদ্রাসাসমূহের মা হিসেবে পরিচিত।
প্রতিষ্ঠাকাল
বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৬ সালে (হিজরী ১৩১০ সনে)। চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত হাটহাজারী মাদ্রাসার আয়তন ৪.৪৩ একর বা ১৭৯২৭ বর্গ মিটার। বর্তমানে প্রায় ১০০ জন শিক্ষক এবং কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে প্রায় ৭ সহস্রাধিক ছাত্র অধ্যায়ন করছে ১২৪ বছরের পুরনো এই মাদ্রাসায়।
দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত দারুল উলূম হাটহাজারী’র শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য রাজনৈতিক চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই মাদ্রাসায় শিশু শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত পাঠ্দানের পাশাপাশি আছে হিফয-কুরআন বিভাগ।
শিক্ষাসেবায় অবদানের ফলে আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম বিতর্কহীন ভাবে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত কওমী মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে।
ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারি মাদরাসা ১৮৯৬ সালে একটি অস্থায়ী ঠিকানায় প্রতিষ্ঠালাভ করে। পরবর্তীতে ১৯০১ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বর্তমান ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়।এই প্রতিষ্ঠানটি এ অঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষাবিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায়। শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজদের আগ্রাসনের ফলে এ অঞ্চলের তৎকালীন সংস্কৃতি ও সামাজিক অবস্থা ইসলামী চিন্তাচেতনা ও মুসলিম আকিদা’র পরিপন্থি ছিল। মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ, সামাজিক জীবনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শিরক-বিদআত এবং মুসলিম সমাজকে বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে, ১৮৬৬ সালে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই একই লক্ষ্যে, তার চিন্তা-চেতনা ও মূলনীতির অনুসরণে বন্দর নগরীর কিছু বিখ্যাত উলামা বিদেশী সংস্কৃতি এবং শিরক-বিদআত এর কবল থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষার উদ্দেশ্যে আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারি মাদরাসা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্তটি কার্যকরের জন্য হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর আদেশানুসারে তার প্রিয় অনুসারী ও ছাত্র শাইখুল ইসলাম মাওলানা হাবিবুল্লাহ রহ. এবং তার সাথে মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ, মাওলানা সুফী আজিজুর রহমান এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ রহ. এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন।
শাইখুল ইসলাম মাওলানা হাবিবুল্লাহ রহ. কর্তৃক ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারি মাদরাসা ১২৩ বছরের সুদীর্ঘ সোনালীপথ অতিক্রম করে এসেছে। মুসলিম উম্মাহের স্বার্থে এই প্রতিষ্ঠানটি এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে। হাটহাজির মাদরাসা–কে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে বহু মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদ, ইসলামিক সেন্টার ও খানকাহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শিক্ষাসেবা ও জাতীয়-সামাজিক পর্যায়ে অবদানের ফলে হাটহাজারী মাদ্রাসা “বিতর্কহীন ভাবে এই দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত মাদ্রাসায়” পরিণত হয়েছে।
সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা
মাদ্রাসাটি বাংলাদেশের প্রধান তিনটি বৃহত্তম মাদ্রাসার মধ্যে অন্যতম। অন্য দুইটি মাদ্রাসা হল পটিয়ার আল-জামিয়াতুল ইসলামীয়া পটিয়া এবং জামিয়া আরবিয়া জীরি। এর সব কয়টি মাদ্রাসা বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অবস্থিত। এই তিনটি মাদ্রাসা একযোগে বাংলাদেশের ৭,০০০ এর অধিক ছোট ইসলামিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।এই তিনটি বৃহৎ মাদ্রাসা প্রায় একই পরিচালনা পর্ষদের অধীনে।
সংস্থা ও প্রশাসন
দ্য দারুল উলুম এর শিক্ষাব্যবস্থা ছয়টি বড় স্তরে বিভক্ত করেছে-
প্রাথমিক স্তর – উর্দু; ফারসি; আরবি; নাহু-সরফ; সিরাত-উন-নবী; ফিকহ ইত্যাদি পড়ানো হয় সাথে গণিত; ইতিহাস; বাংলা; ইংরেজি এবং ভূগোল.
মাধ্যমিক স্তর - উচ্চতর আরবি ব্যাকরণ; আরবি সাহিত্য; ফিকহ; যুক্তি
উচ্চ মাধ্যমিক স্তর - উচ্চতর ফিকহ ও উসুল-এ-ফিকহ; উচ্চতর যুক্তি; ঊর্ধ্বতন আরবি সাহিত্য; উচ্চতর অর্থনীতি; উচ্চতর দর্শন; উচ্চতর ইসলামের ইতিহাস।
স্নাতক স্তরের – হাদীস; তাফসির; আরবি ও ফারসি কবিতা; সৌর বিজ্ঞান।
স্নাতকোত্তর স্তর - ছয়টি প্রধান হাদীস বই: বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, তিরমিদী শরীফ, নাসায়ে শরীফ এবং ইবনে মাজাহ মূলত শেখানো হয়।
স্নাতকোত্তর স্তরের বাইরে - ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে আরও অধ্যয়ন; আরবি ভাষা ও সাহিত্য; উচ্চতর হাদীস অধ্যয়ন, বাংলা সাহিত্য এবং ইসলামিক পড়াশোনা।
মাদ্রাসাটির গুরুত্ব
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বেশিরভাগই হাটহাজারীর এই কওমি মাদ্রাসার নির্দেশনা অনুসরণ করে থাকে। একাডেমিক দিক থেকেও দেশে সবচেয়ে বড় এই কওমি মাদ্রাসার গুরুত্ব রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, দুই দশক ধরে বিভিন্ন সরকার বা বড় রাজনৈতিক দলগুলোও হাটহাজারীর এই মাদ্রাসাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে এর একটা রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক সময় দৃশ্যমান হয়েছে।
বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালে লংমার্চ এবং ঢাকা অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিল। সংগঠনটি তখন ১৩ দফা দাবি তুলেছিল। সেই হেফাজতে ইসলামের আমীর হচ্ছেন আহমদ শফী এবং মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, হাটহাজারীর মাদ্রাসাটি যেমন রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হওয়ার অভিযোগও রয়েছে।