
লোভাছড়া- lovachara
সিলেট মানেই প্রকৃতির রূপের প্রাচুর্য আর মোহনীয়তার এক উপাখ্যান। ভুবন ভোলানো সৌন্দর্য লোভাছড়া যেন বিছিয়ে রয়েছে সিলেটের বাঁকে বাঁকে। পলকেই পর্যটককে তার অমোঘ মায়ায় বাঁধতে প্রকৃতির এই কন্যাটির জুড়ি নেই। শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে কানাইঘাট উপজেলার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষা খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে স্বচ্ছ পানির নদী হচ্ছে লোভাছড়া। এখানের চোখ জুড়ানো সবুজের আস্ফালন আর দিগন্তজোড়া পাহাড় ছুঁয়ে নীল কুয়াশার আকাশ এখানে নীল সবুজের মিশেলে কল্পনার সৌন্দর্যকেও হার মানায়।
লোভাছড়া থেকে ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয় হাতছানি দিয়ে ডাকে পর্যটকদের। এখানকার যেকোন উঁচু পাহাড়ে উঠলে মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় খুব কাছ থেকে দেখতে পাবেন। মূলত ‘লোভাছড়া চা বাগান’ই নাম এই স্থানটির। আর এই চা বাগানের সূত্র ধরেই গোটা এই বিশাল এলাকার নাম হয়েছে লোভাছড়া। চা বাগানের রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাছ, ঘন সবুজ বনানী, প্রাকৃতিক লেক আর স্বচ্ছ জলধারার ঝর্ণা আপনার নজর কাড়বে। পথের এক জায়গায় পেয়ে যাবেন শত বছরের পুরনো বিরাটাকার এক বট বৃক্ষ। এমন বৃক্ষ আপনি কোনো দিনও দেখেননি। চারপাশে শতাধিক ডালপালা নিয়ে সদম্ভে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষটি যেন কালের সাক্ষী হয়ে দণ্ডায়মান হয়ে আছে।
অবস্থান
মুলাদি বাজার যাওয়ার পথেই পড়বে “লোভাছড়া চা বাগান”। কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের অর্ন্তভূক্ত এই সীমান্তবর্তী লোভাছড়া নদীর পাশেই ব্রিটিশ আমলে প্রায় ১৮৩৯ একর জমির উপর ইংরেজ মালিকানায় গড়ে ওঠে লোভাছড়া চা-বাগান। বাগানের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের একটি সুন্দর পিকনিক স্পট ও লালাখাল চা-বাগান অবস্থিত। পাহাড়ের কোল জুড়ে গাছপালার সবুজ বর্ণিল রঙয়ে আচ্ছাদিত হয়ে আছে লোভাছড়া চা-বাগান।
কিভাবে যাবেন
লোভাছড়া যেতে হলে প্রথমে আসতে হবে চায়ের দেশ সিলেটে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সিলেট আসা যায়। বাস, ট্রেন কিংবা আকাশ পথে যে কোন উপায়েই সিলেট আসতে পারবেন।
ঢাকা থেকে সিলেট বাসে
ঢাকা থেকে সিলেটগামী যে কোন বাসে সিলেট আসা যাবে।ঢাকা থেকে সিলেট এর দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার, ঢাকার ফকিরাপুল, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালি ও আবদুল্লাপুর বাস টার্মিনাল থেকে সিলেটের বাস ছেড়ে যায়৷ গ্রীন লাইন, সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলি ও এনা পরিবহনের এসি বাস যাতায়াত করে।এগুলোর ভাড়া সাধারণত ৮০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও ঢাকা থেকে সিলেট যেতে শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এনা পরিবহনের নন এসি বাস জনপ্রতি ৪২০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়ায় পাবেন। সকাল, দপুর কিংবা রাত সব সময়ই বাস ছেড়ে যায়।সিলেট পৌঁছাতে সাধারণত সময় লাগে ৬ ঘন্টার মত।
ঢাকার কমলাপুর কিংবা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে উঠতে পারেন।বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে উঠতে হলে কমলাপুর থেকে যে ট্রেন গুলি ছেড়ে যায় তার সাথে ২০ মিনিট সময় যোগ করে নিবেন।কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ০৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস।শ্রেণী ভেদে জনপ্রতি ট্রেনে যেতে ভাড়া পরবে ৩০০ থেকে ১২০০ টাকা।যে কোন ট্রেনকে বেছে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে। ট্রেনে সিলেট যেতে সময় লাগে ৭-৮ ঘন্টা।
ঢাকা থেকে বিমানে সিলেট
ঢাকা থেকে সবচেয়ে দ্রুত সময়ে ও সাচ্ছন্দে যেতে আকাশ পথকে বেছে নিতে পারেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, রিজেন্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার, নভো এয়ার এবং ইউএস বাংলা এয়ারের বিমান প্রতিদিন সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ক্লাস অনুযায়ী ভাড়া সাধারণত ২৭০০-৯,০০০ টাকা এর মধ্যে হয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম থেকে বাসে সিলেট
চট্রগ্রাম থেকে গ্রীন লাইন, এনা, সৌদিয়া সহ অন্যান্য আরও অনেক বাস সিলেট যায়। এসি ও নন এসি এসব বাসের ভাড়া ৭০০-২০০০ টাকা।
চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে সিলেট
সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে যায় উদয়ন এক্সপ্রেস।শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস।পাহাড়িকা এবং উদয়ন এক্সপ্রেস নামের দুটি ট্রেন সপ্তাহে ৬ দিন চলাচল করে।যে কোন ট্রেনকে বেছে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে।
সিলেট থেকে লোভাছড়া
লোভাছড়া যেতে হলে সিলেট শহরের কদমতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রথমে কানাইঘাট যেতে হবে। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৪৫-৫০ টাকা। তারপর কানাইঘাট বাজার থেকে নৌকাঘাটে গিয়ে সুরমা নদীর পথ ধরে লোভাছড়ার উদ্দেশে যেতে হবে নৌকায় করে। জনপ্রতি ৩০ টাকা এবং রিজার্ভ নিলে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে লোভাছড়ার দূরত্ব মাত্র ৯ কিলোমিটার। উপজেলা সদর থেকে সড়ক ও নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়া যায়। লোভাছড়ায় যাতায়াতের রাস্তাটির অর্ধেকের চেয়ে বেশি কাঁচা হওয়ায় খুবই কষ্ট করে সেখানে পৌঁছাতে হয়। তাই নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়াই সহজ রাস্তা।
কোথায় থাকবেন
লোভাছড়ায় খাওয়া এবং থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই সাধারণত পর্যটকরা সিলেট জেলা শহরেই ফিরে আসেন। যেখানে সিঙ্গেল রুম ৪০০টাকা (দুই জন আরামসে থাকতে পারবেন), তিন বেডের রুম ৫০০টাকা (নরমালই ৪জন থাকতে পারবেন)। রাত যাপনের জন্য দরগা রোডে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রুম ভাড়া ৫০০/- টাকা থেকে ৫০০০/- টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও হোটেল হিল টাউন, গুলশান, দরগা গেইট, সুরমা,কায়কোবাদ ইত্যাদি হোটেলে আপনার প্রয়োজন ও সামর্থ অনুযায়ী থাকা যাবে।
কোথায় খাবেন
লোভাছড়ায় খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই আপনি চাইলে দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। তবে,পর্যটকেরা সচরাচর সিলেট শহরে এসে খাওয়া-দাওয়া করে থাকে জিন্দাবাজারের জল্লারপাড় রোডে অবস্থিত পানসী, পাঁচ ভাই কিংবা পালকি রেস্টুরেন্টে সুলভ মূল্যে পছন্দ মত দেশী খাবার খেতে পারেন। এছাড়াও এই রেস্টুরেন্ট গুলোতে নানা রকম দেশী খাবার ও ভর্তা ভাজি পাওয়া যায়।এইসব রেস্টুরেন্টের বাহারী খাবার পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া সিলেট শহরে বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট আছে, পছন্দ মত যে কোন জায়গায় খেয়ে নেওয়া যাবে।
যাত্রা পথে যা দেখবেন
এখানকার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে চা বাগান, প্রাকৃতিক লেক ও ঝর্ণা, ঝুলন্তসেতু, মীরাপিং শাহর মাজার, মোঘল রাজা-রানির পুরাকীর্তি, প্রাচীন দীঘি, পাথর কোয়ারি ও বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন।