মুরারিচাঁদ কলেজ-Murarichand College
মুরারিচাঁদ কলেজ (সংক্ষেপে: এমসি কলেজ) বাংলাদেশের একটি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি সিলেট শহরের টিলাগড় এলাকায় অবস্থিত এবং বৃহত্তর সিলেটের সবচাইতে পুরনো ও শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাকালের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোর মধ্যে ৭ম; সারা বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠা এক অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৮৯২ সালের ২৭ জুন রাজা রাজা গিরিশচন্দ্র রায় (১৮৪৫ – ১৯০৮) এর অনুদানে প্রতিষ্টিত হয়।কলেজটির নামকরণ করা হয় তার প্রমাতামহ মুরারিচাঁদ এর নামে ।
প্রতিষ্টানটি প্রকৃতিক পরিবেশে এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে যদি কোন নতুন আগন্তুক না জেনে এই ক্যম্পাসে প্রবেশ করে তাহলে সে প্রথমেই ধরে নিবে এটি হয় কোন রাজবাড়ী,অথবা কোন রাজার বাগানবাড়ী অথবা কোন উদ্যান বা পার্ক। কেননা একটি পার্কে বা উদ্যানে মানুষকে প্রকৃতিক পরিবেশে বিনোদন দেয়ার জন্য যা যা আয়োজন থাকার কথা তার সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই ক্যাম্পাসে।
কি নেই এই ক্যাম্পাসে । ১২৪ একর ভূমির উপর প্রতিষ্টিত এই ক্যাম্পাসে আছে পাহাড়, টিলা ,পুকুর,সান বাঁধানো পুকুর ঘাট,পুকুরে ফুটা পদ্মফুল, টিলার ফাঁকে ফাঁকে এঁকে বেঁকে চলা পিচঢালা পথ।
পাহাড়ের উঁচুতে উঁচুতে প্রাচীন স্থাপত্যের আদলে নির্মিত দালান কোঠা ,আবার সমতল ভূমিতে প্রাচীন নির্মান শৈলীতে বেটনে নির্মান করা দু চালা টিনের লম্বা ঘর।
পাহাড়ের উপরে উঠার জন্য প্রাচীন কালে নির্মিত দীর্ঘ সিঁড়ি। সিড়ির চূড়ায় উঠে যদি কেউ ক্লান্ত হয়ে যায় তার ক্লান্তি নিবারনের জন্য সিড়ির শেষ প্রান্তে আছে বাঁধানো বসার বেঞ্চ। বর্ষা কালে যেন কোথাও পানি না জমে সেই উদ্দেশ্যে পুরো ক্যাম্পাসের চারদিকেই রয়েছে লাল ইটের সাজানো গোছানো পানি নিষ্কাশন ( ড্রেনেজ ) ব্যবস্থা।
দুচালা টিনের বেটনের এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাবার জন্য রয়েছে ছাউনি বেষ্টিত পায়ে হাঁটার পথ।
আছে প্রায় দু একর জায়গা জুড়ে বিশাল কাজলা দিঘি নামে বিরাটকার এক দিঘি। দিঘির চর্তুদিকে আছে বৃত্তাকার পিচঢালা পথ। পুকুরের বাঁ দিঘির দু পাশে আছে সান বাঁধানো দুটি ঘাট।
পুরো পুকুর বা দিঘির জলে ফুঁটে আছে লাল শাপলা যা দেখে যেকোন নতুন আগন্তুক মুহুর্তের মধ্যে অন্য এক জগতে হারিয়ে যাবে।
শাপলা ছাড়া যে টুকু দিঘির মুক্ত এলাকায় পানি রয়েছে সেখানে যদি কেউ তাকায় তাহলে প্রথমেই বিভ্রান্ত হবে।
কেননা দিঘির এই শান্ত স্নিগ্ধ জলে তাকালে প্রথমেই মনে দ্বিধার সৃষ্টি হবে। কারন দিঘির শান্ত নিরব জলে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা নীলাভ আকাশ তার পুরোটা আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে। আর শান্ত দিঘির জল উদার মনে তার আপন বুকে আকাশের প্রতিচ্ছবি ধারন করেছে। এই চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে যে কোন আগন্তুকের ইচ্ছেই হবে কাজলা দিঘির শান্ত জলে হাত দেবার। তার চেয়ে ইচ্ছে হবে অনাদিকাল চেয়ে থাকার।
এই কাজলা দিঘির পাড়ে বসেই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্টি করেছেন তার অমর কিছু সাহিত্য।
হঠাৎ যদি কোন পাখির কিচিরমিচির শব্দে আপনার সম্বিৎ ফিরে আসে তাহলে আপনি চোখ তুলে যেদিকেই তাকাবেন দেখবেন শুধু সবুজ আর সবুজ।
ডানে বায়ে সামনে পেছনে যে দিকেই তাকান আপনার চোখে শুধু সবুজ আর সবুজ ধরা দেবে। টিলার উপ থেকে নিচ পর্যন্ত পুরোটাই দেখবেন সনুজে মুড়ানো।
ভুলেও ভাববেন না এই সবুজ ঘাস কেউ লাগিয়েছে। ভুল,পুরোটাই ভুল। ওটা প্রকৃতি তার আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে সবুজ ঘাসের গালিচায় পুরোটা ক্যাম্পাস সাজিয়ে নিয়েছে।
চোখ তুলে যদি একটু উপরে তাকান তাহলে দেখবেন হাজারো প্রজাতির গাছ পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর এই গাছের মধ্যে সংসার সাজিয়ে নেয়া পাখ পাখালির কিচিরমিচির সুলোলিত ধ্বনি আপনের মনে এক ভিন্ন রকমের অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে ।
ক্যম্পাসটি সীমানা প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। তাই আপনি ঘুরতে গিয়ে পুরোটাই নিরাপদ। এর বাইরেও ক্যাম্পাসের উল্যেখযোগ্য স্থানে সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে । সুতরাং ঘুরতে গিয়ে বিপদে পড়ার কোন ভয় নেই।
ক্যাম্পাসে রয়েছে প্রায় ষাট হাজার বইয়ের এক সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। রয়েছে ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদার্পন কে স্মরনীয় করে রাখার জন্য তার স্মৃতি ম্যুরাল।পাহাড়ের উপরে নির্মিত এই স্মৃতি ম্যুরাল সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে এই শতবর্ষী প্রতিষ্টানে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচারনার বার্তা।
ক্যাম্পাসে প্রবেশের রাজকীয় তোরন অতিক্রম করে যেই আপনি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবেন অম্নি বাঁ দিকে তাকালেই দেখবেন বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ট সন্তান জাতির জঙ্ক বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। উঁচু এক টিলার উপর উনার ম্যূরাল স্থাপন করা হয়েছে। যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।
টিলার উপরে উপরে এক একটা বিভাগের ভবন সবাইকে জানিয়ে দেয় বিভাগের স্বতন্ত্রতার কথা। ক্যাম্পাসের সর্বোচ্চ পাহাড়ের উপরে রয়েছে প্রাচীন আভিজাত্যে নির্মিত অধ্যক্ষের বাস ভবন। তার চেয়ে নিচু টিলায় রয়েছে অধ্যক্ষের প্রশাসনিক ভবন ।যেখান থেকে নিপুন হাতে তিনি পরিচালনা করছেন ছায়া সুনিবিড় এই অনিন্দ সুন্দর এই সবুজ ক্যাম্পাস।
আগত কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যেন প্রাকৃতিক মনোরম খোলামেলা পরিবেশে শিক্ষা গ্রহন করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে শুরুথেকেই এই উদ্যানের পরিবেশ বজায় রেখেই এই শিক্ষা প্রতিষ্টান গড়ে তুলা হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে এর পরিধি বৃস্তৃত করলেও যেন মনোরম উদ্যানের পরিবেশ বিনষ্ট না হয় সেদিকে কর্তৃপক্ষের সতর্ক নজরদারি রয়েছে । যেমন রয়েছে শিক্ষার্থীর সুশিক্ষা গ্রহনের দিকে।
উদ্যানের বা এই প্রাকৃতিক পার্কের ভেতর সুশৃঙ্খল মনোরম পরিবেশে এমন ভাবে শিক্ষার দীক্ষা দেয়া হয় বলে এই শতবর্ষী বিদ্যাপীটকে শিক্ষা পার্ক বললে খুব একটা ভুল হবে বলে আমার মনে হয় না। আর যদি কেঊ দ্বিমত পোষণ করেন তাহলে আমি বলব এটি একটি বিদ্যাপীট এই কথাটি যদি মনের বেখেয়ালে ভুলে যান তাহলে এটিকে একটি উদ্যান বা পার্ক ভাবতে নিশ্চই আপনার খুব একটা কষ্ট হবেনা।
একবার ঘুরে যাবার আমন্ত্রণ রইল এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বিদ্যাপীটে। ভ্রমন গাইড হিসেবে আমার সহযোগিতা নিতে পারেন।ক্যাম্পাসটা আপনাকে বার বার টানবে হৃদয় থেকে এ আমি নিশ্চিত।
এক নজরে কলেজের পরিসংখ্যান-
অনুষদ ও বিভাগ সমূহ-
কলা অনুষদ
ইংরেজি বিভাগ
বাংলা বিভাগ
ইতিহাস বিভাগ
দর্শন বিভাগ
উর্দু বিভাগ
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
একাডেমিক সু্যোগ সুবিধা
একাডেমিক ভবন
বর্তমানে কলেজে ৯টি একাডেমিক ভবন রয়েছে। এ ভবনগুলো প্রধানত শ্রেণীকক্ষ, লাইব্রেরী ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ বিভাগেরই নিজস্ব ভবন রয়েছে।
লাইব্রেরি
এই কলেজের লাইব্রেরিটি সমগ্র সিলেটের এমনকি বাংলাদেশেরই একটি অন্যতম প্রাচীন লাইব্রেরি। বর্তমানে এই লাইব্রেরিতে ৬০,০০০-এর অধিক বই রয়েছে। একই সাথে সকল বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নিজস্ব সেমিনার লাইব্রেরি রয়েছে ।
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জ্যুওলজিক্যাল মিউজিয়াম
কলেজ ক্যাম্পাসে ১টি ছোটখাট বোটানিক্যাল গার্ডেন আছে। এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ রক্ষনাবেক্ষন করে থাকে। এটি সমগ্র সিলেটের একমাত্র বোটানিক্যাল গার্ডেন। এছাড়া কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগে একটি জ্যুওলজিক্যাল মিউজিয়াম আছে। এতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর একটি বিশাল সংগ্রহ রয়েছে।
কলেজের সুযোগ সুবিধা সমূহ
হোস্টেল
বর্তমানে কলেজে ২টি হোস্টেল রয়েছে। একটি ছাত্রদের ও অপরটি ছাত্রীদের জন্য। ছাত্রদের হোস্টেলটি ৬ টি ব্লকের সমন্বয়ে গঠিত যার মধ্যে ১টি ব্লক হিন্দু ছাত্রদের জন্য এবং বাকি ৫টি ব্লক মুসলমান ছাত্রদের জন্য। ছাত্রাবাসের পুকুরের পূর্বপাশে নতুন ৪তলা বিশিষ্ট আরো একটি ছাত্রাবাস চালু হয়েছে ছাত্রদের জন্য।
পরিবহন
শিক্ষার্থীদের পরিবহন সুবিধার জন্য ২টি বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। যার মধ্যে একটি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও আরেকটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শিক্ষার্থীদের উপহার দিয়েছিলেন। এছাড়া কলেজ প্রশাসনের কাজের জন্য একটি জ্বীপ ও একটি মাইক্রোবাস রয়েছে।
খেলার মাঠ
ছাত্রদের হোস্টেলের উল্টোপাশে রয়েছে কলেজের নিজস্ব সুবিশাল খেলার মাঠ।
কলেজ ক্যান্টিন
কলেজের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি ক্যান্টিন যা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজে থাকাকালীন সময়ে খাবারের চাহিদা পূরণ করে।
পোস্ট অফিস
কলেজ ক্যাম্পাসের পাশে রয়েছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ-এর একটি পোস্ট অফিস।
সহশিক্ষা কার্যক্রম
মুরারিচাঁদ কলেজে বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে; সেগুলো হলঃ
রোভার স্কাউট – বাংলাদেশ স্কাউটস এর রোভার অঞ্চল এ সিলেট জেলা রোভার স্কাউটস এর অধীনে ৩টি রোভার ইউনিট ও একটি গার্ল ইন-রোভার ইউনিট রয়েছে।
বি.এন.সি.সি. – কলেজের বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর এর ময়নামতি ব্যাটলিয়ন এর অধীন একটি প্লাটুন রয়েছে ।
মুরারিচাঁদ ডিবেট ফেডারেশন(এমসিডিএফ)-২০১৭ সালের ১৪ই নভেম্বর এমসি কলেজের কিছু ছাত্রের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে মুরা্রিচাঁদ ডিবেট ফেডারেশন(এমসিডিএফ) তথা এমসি কলেজ ডিবেট ফেডারেশন।যাত্রার মাত্র এক বছরের ভেতরেই ২০১৮ সালের ২০ ই ডিসেম্বর ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক আয়োজিত ডিবেট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮ তে সিলেট বিভাগের চ্যম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে মুরারিচাঁদ ডিবেট ফেডারেশন এর বিতার্কিকরা। এছাড়াও ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশন(NDF-BD)কর্তৃক আয়োজিত ৩য় এনডিএফ বিডি ডিভিশনাল ডিবেট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮ তে রানারআপ হয় এমসিডিএফ এর বিতার্কিকরা।আঞ্চলিক বিতর্কে সিলেট বিভাগের সেরা স্থান লাভ করে মুরা্রিচাঁদ ডিবেট ফেডারেশনের বিতার্কিক শাখাওয়াত তুহিন।সর্বশেষ এমসি কলেজ ,সিলেট কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহ ২০১৮ এর ১০ টি ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ ১৭ টি পুরুষ্কার লাভ করে এমসিডিএফ এর বিতার্কিকরা।
মুরারিচাঁদ কলেজ প্রেসক্লাব – ২০১৭ এর ১৩ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসে কর্মরত সংবাদকর্মীদের সংগঠন হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ প্রেসক্লাব।
মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ
ডিবেটিং ক্লাব
ধ্রুবক ক্লাব-গণিত বিভাগ
টুরিস্ট ক্লাব
থিয়েটার মুরারিচাঁদ
মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন
ইকোনমিক্স ক্লাব
কেমিস্ট্রি ক্লাব
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমঃ
প্রতিবছর মুরারিচাঁদ কলেজে বাংলা নববর্ষ এর অনুষ্ঠান বেশ জাকজমকভাবে উদযাপিত হয়। সকল পেশার,সকল শ্রেণীর মানুষ এই অনুষ্ঠানে স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে, যা এই অনুষ্ঠানকে এতদঞ্চলের সবচাইতে জাঁকজমকপুর্ণ আয়োজনে পরিনত করেছে।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া