নিপা ভাইরাস কি, লক্ষণ এবং প্রতিরোধের উপায়
নিপাহ অপেক্ষা-কৃত নতুন ভাইরাস, যা অতি সহজেই বাদুড় জাতীয় তৃণভোজী প্রাণী থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। শুধুমাত্র বাদুড় নয়, নিপাহ শূকরের বর্জ্য থেকেও ছাড়াতে পারে। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। ভাইরাসটি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শূকরের খামারে কাজ করা চাষীদের মাধ্যমে প্রথম ছড়িয়েছিল। আক্রান্ত শূকরের স্পর্শ, তাদের লালা ও সংক্রমিত মাংসের মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটে। পরে রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়৷
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এ সময়টাতে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে এবং রসের হাড়িতে প্রস্রাব করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা ও মুত্র মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই কাঁচা রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ।
সরাসরি নিপাহ ভাইরাস নিরাময়ে কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়নি। ভাইরাসটি আবিষ্কার করেন ড: কো বিং চুয়া।
নিপা ভাইরাস কি (What is Nipah virus)
নিপাহ ভাইরাস একটি Emerging Zoonotic ভাইরাস, যা পশু-পাখি থেকে মানুষে ছড়ায়। ভাইরাসটি মস্তিষ্ক বা শ্বসনতন্ত্রে প্রদাহ তৈরির মাধ্যমে মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করে। এটি Henipavirus জেনাসের অন্তর্গত একটি ভাইরাস। নিপাহ ভাইরাসে এনসেফালাইটিস নামক মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ হয়।
কিভাবে ছড়ায়?(How does Nipah virus spread?)
ভাইরাসটি সাধারণত বাদুড় ও শূকর বহন করে থাকে।
ভাইরাসবাহী বাদুড় যখন কোনো ফল খায় বা খেজুরের রস পান করে তখন বাদুড়ের লালা সরাসরি সেই ফল বা খেজুরের রসকে দূষিত করে। এরপর কোনো মানুষ যদি এই দূষিত ফল খায় বা কাঁচা খেজুরের রস পান করে, তাহলে সে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। একবার প্রাণী থেকে মানুষে প্রাথমিক সংক্রমণ হলে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ সম্ভব। এ ছাড়া সংক্রমিত প্রাণীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বা তাদের দেহ থেকে তরল (যেমন—রক্ত, প্রস্রাব বা লালা)-এর মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।
আক্রান্ত মানুষের হাঁচি-কাশির মাধ্যমেও দ্রুত অন্যান্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
নিপাহ ভাইরাস মানুষের শরীরে কী করে?(What does Nipah virus do in the human body?)
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিপাহ ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকার পরে, রক্তনালীর অন্তরাবরণীর কোষ এবং মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষকে আক্রমণ করে। রক্তনালীর ভেতরের আবরণী কোষ আক্রান্ত হওয়ায় প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। অর্থাৎ রক্তনালীর প্রদাহ এবং রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া এ রোগের মূল ক্ষতিকর প্রক্রিয়া নিপাহ ভাইরাস মস্তিষ্কের ভেতরের রক্তনালী ছাড়া ফুসফুস হৃৎপিণ্ড এবং কিডনির রক্তনালীকেও আক্রমণ করতে পারে। তবে এই ভাইরাস এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছোট ছোট রক্তনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করলেও মাঝারি এবং বড় রক্তনালীতে কোনো প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে না। এ ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে মস্তিষ্ক প্রদাহের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ফুসফুস এবং এ কারণে রোগীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হতে দেখা যায়।
নিপা ভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ (Symptoms of Nipah virus)
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত কিছু ব্যক্তি থাকে উপসর্গবিহীন। নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণগুলো সাধারণত সংস্পর্শে আসার চার থেকে ১৪ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। অন্যদিকে এটি ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় শরীরে থাকতে পারে।
লক্ষণগুলো হলো :
জ্বর, মাথা ব্যথা, কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বমি। এরপর খিঁচুনি এবং এনকেফালাইটিস বা মস্তিষ্কের ফোলাভাব হতে পারে, যা বিভ্রান্তি, তন্দ্রার মতো সমস্যা সৃষ্টি করে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত কিছু কিছু ব্যক্তির রোগ সেরে যাওয়ার পরও অনেকের চিরস্থায়ী মস্তিষ্কের সমস্যা হতে পারে। এনকেফালাইটিস থেকে বেঁচে যাওয়া নিপাহ আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কারো কারো দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন—খিঁচুনি বা ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন। সুতরাং বলা যায়, এটি একটি বিপজ্জনক ভাইরাস।
রোগনির্ণয়
যেহেতু ভাইরাসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অন্যান্য অবস্থার উপসর্গও হতে পারে, ডাক্তাররা খুব কমই প্রথমে নিপাহ নির্ণয় করেন। নানা পরীক্ষার মাধ্যমে এটি নির্ণয় করতে পারেন চিকিৎসকরা। যেমন—
রিয়েল-টাইম পলিমারেজ চেইন রি-অ্যাকশনা (পিসিআর) : প্রাথমিক পর্যায়ে নিপাহ ভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য গলা বা অনুনাসিক সোয়াব, সেরিব্রোস্পাইনাল (মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ড) তরল, প্রস্রাব এবং রক্ত ব্যবহার করা হয়।
এনজাইম-লিংকড ইমিউনোসর্বেন্ট অ্যাসে (অ্যালাইজা) : চিকিৎসকরা অ্যান্টিবডিগুলো সন্ধান করতে এই পরীক্ষা করেন। এটি পরবর্তী পর্যায়ে বা সেরে ওঠার পরে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।
কীভাবে খেজুরের রস থেকে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়?
রস সংগ্রহের জন্য গাছিরা সারারাত একটি পাত্র গাছে ঝুলিয়ে রাখেন। যেখানে নিশাচর প্রাণী বাদুড় রস পান করতে আসে। বাদুড় যখন খেজুরের রসে মুখ দেয় তখন তাদের মুখ থেকে নিঃসৃত লালা এমনকি তাদের মলমূত্র খেজুরের রসের সঙ্গে মিশে যায়। এই দূষিত রস কাঁচা অবস্থায় খেলে নিপাহ ভাইরাস সরাসরি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। ফলে জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, কাশি, বমি, ডায়রিয়া সহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। মাথায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পরলে মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।
খেজুরের রস যেভাবে খাবেন?
নিপাহ্ ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে এখনো কোনো টিকা বা কার্যকর চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। এ কারণে খেজুরের রস খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। প্রথমত রস সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে দ্রুত রস বিতরণ করার ও ঢেকে রাখার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ভাইরাস থেকে নিস্তার পাওয়ার প্রধান উপায় হলো গাছগুলোর রস সংগ্রহের স্থানটাতে প্রতিরক্ষামূলক আবরণ বা স্যাপ স্কার্ট ব্যবহার করা। যেন বাদুড় হাড়ির কাছে আসতে না পারে।
চিকিৎসা
বর্তমানে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোন কার্যকরী চিকিৎসা নেই। সাধারণতঃ সহায়ক চিকিৎসা দ্বারা এই রোগ উপশমের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। নিপাহ ভারিরাস দ্বারা আক্রান্ত এমন প্রত্যেক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখা প্রয়োজন এবং প্রগাঢ় সহায়ক চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। পরীক্ষাগারে রিবাভিরিনের কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেলেও মানব শরীরের এর প্রভাব এখনো প্রমাণিত নয়। নিপাহ জি গ্লাইকোপ্রোটিনের বিরুদ্ধে উৎপাদিত একটি হিউম্যান মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে টীকাকরণের প্রভাব পরীক্ষা চলছে। নিপাহ ভাইরাসের পূর্ণতালাভের পক্ষে ক্লোরোকুইন অন্তরায় সৃষ্টি করলেও মানবশরীরে এর কার্যকারিতা এখনো পরীক্ষিত নয়। অস্ট্রেলিয়ায় হিউম্যান মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি এম ১০২.৪ মানবশরীরে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
নিপা ভাইরাসের প্রতিরোধের উপায় (Ways to prevent Nipah virus)
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোনো কার্যকর চিকিৎসা না থাকায় সঠিক রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
* কাঁচা খেজুরের রস পান থেকে বিরত থাকুন।
* যেকোনো ফল খাওয়ার আগে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
* বাদুড় বা অন্য কোনো পাখির আংশিক খাওয়া ফল খাবেন না।
* নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি বা রুগ্ণ পশু থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
* প্রাণী বিশেষ করে শূকরের খামারে কাজ করার সময় সতর্ক থাকুন।
* আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্সদের বিশেষ সতর্কতা, যেমন মুখে মাস্ক-গ্লাভস-গাউন ব্যবহার, রোগী দেখার পর হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধোয়া ইত্যাদি অবলম্বন করা উচিত।
* রোগীর ব্যবহার করা কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী সাবান দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করুন।
* নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর কফ ও থুতু যেখানে-সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।