ভোলাটুকি গাছের ঔষধি ও ভেষজ গুনাগুন - Medicinal and herbal properties of The marking nut tree
ভোলাটুকি, ভল্লাত, ভল্লাতক হচ্ছে এনাকারডিয়াসি পরিবারের সেমেকারপাস গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। বাংলায় ভেলা, হিন্দীতে ভিলাবা প্রভৃতি বলা হয়ে থাকে।
ইংরেজি নাম: marking nut tree, Malacca bean tree, marany nut, oriental cashew, phobi nut tree and varnish tree
বৈজ্ঞানিক নাম: Semecarpus anacardium
পরিচিতি:
এটি ছোট আকারের পাতাঝরা স্বভাবের বৃক্ষ। গাছের মাথায় প্রচুর শাখা-প্রশাখা ও পাতা থাকায় তা ছাতার মতো দেখায়। মধ্যমাকৃতি গাছ ৮/১০ মিটারের বেশি উচু হতে সাধারণতঃ দেখা যায় না। ছাল ধূসর রঙের। পাতার গোড়ার দিকটা হৃৎপিণ্ডাকৃতি, অগ্রভাগ সরু, পাতা মোটা। পাতার উপরিভাগে কোমল লোম এবং নিম্ন দিকে সূক্ষ্ম লোম আছে, আকারেও বেশ বড়। বসন্তকালে গাছে পাতা থাকে না।
স্ত্রী পুষ্প এবং পুং পুষ্প ভিন্ন ভিন্ন গাছে হয়। কদাচিৎ একই গাছে দু’ রকমের ফুল হয়ে থাকে। পাপড়ি সুবজাভ সাদা।
ফল শাঁসযুক্ত, পাকলে লালবর্ণ, মধুর, লোকে খায়। ফলে একটি বীজ থাকে। বীজের মজ্জা বা শাঁস নানাপ্রকার মিষ্টান্ন তৈরীর কাজে কাজুর মত ব্যবহৃত হয়। ফল পাকলে কৃষ্ণ ও হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করে। ফল ছোট, আকারে বড় জোর ২.৫ সেমি। পাকলে খোসার রঙ বেগুনি হয়ে যায়। কচি ফল টক, লবণ মিশিয়ে খাওয়া যায়, আচার তৈরি করা যায়। বলা হয়, বীজের শাঁস খেলে মেধা ও স্মরণশক্তি বাড়ে। এছাড়াও এজমা, ত্বকের সংক্রমণ, জ্বালাপোড়ায় বীজের ব্যবহার করা হয়। ভোলাটুকির গাছ এখন কম দেখা যায়। ফুল মে ও জুন মাসে এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে ফল হয়।
ভোলাটুকি-এর ভেষজ গুনাগুন:
এটি প্রধানভাবে কাজ করে রসবহ ও রক্তবহ স্রোতে।
১. ক্রিমিরোগে: যেসব ক্রিমির উপদ্রব কোন ঔষধেই কমানো যাচ্ছে না কিংবা কেঁচো ও ফিতে ক্রিমি পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, সেক্ষেত্রে হরীতকী চূর্ণ ৯০ গ্রাম, তার সঙ্গে শোধিত ভেলা (ঘিয়ে ভাজা) ১০ গ্রাম একসঙ্গে কুটে চালনিতে ছেঁকে নিয়ে সেই চুর্ণ এক মাত্রায় সকালে খালি পেটে জল সহ খেতে হবে। তবে অনেকে গরম জলে খাওয়ার ব্যবস্থা দেন, কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে গরম দুধ বা জলের সঙ্গে ব্যবহারে শরীরে এলার্জি এসে যায়। সুতরাং দুধ গরম করে ঠাণ্ডা হলে সেই দুধ বা ঠাণ্ডা জল ব্যবহার করা উচিত।
২. অম্লরোগে: তেঁতুল চটা পোড়ানো ছাই ৯০ গ্রাম, আর শোধিত ঘিয়ে ভাজা। তেল ১০ গ্রাম একসঙ্গে চূর্ণ করে চালনিতে ঘেঁকে সেই চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় সকালে খালি পেটে একবার, প্রয়োজন হলে বৈকালের দিকে একবার সিকি কাপ দুধ সহ খেতে হবে। এইটা কয়েক দিন খেলে পেটে বায়ু, বুক জ্বালা ও অম্বলের দোষ সেরে যায়।
৩. অসাড়ে মূত্রনিঃসরণ: এটা বেশি বয়সেই দেখা দেয়, এমনকি মূত্রের বেগ এলে থামানো যায় না। এক্ষেত্রে নিসিন্দা পাতার (Vitex nigundo) চুর্ণ ৪০ গ্রাম, তার সঙ্গে শোধিত ঘিয়ে ভাজা ভেলা ১০ গ্রাম একসঙ্গে মিশিয়ে চূর্ণ করে হেঁকে সেই চুর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় প্রত্যহ সিকি কাপ দুধ সহ একবার করে খেতে হবে। তবে ৫/৭ দিন ব্যবহার করার পর এটা বন্ধ করে দিতে হবে এবং কিছুদিন বাদে আবার খেতে হবে।
৪. রক্তপ্রদরে: লোধ (Desmodium pulchellum) ৯০ গ্রাম, শোধিত ঘিয়ে ভাজা ভেলা ১০ একসঙ্গে চূর্ণ করে হেঁকে ঐ চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় দুধ সহ প্রত্যহ একবার করে খেতে হয়। কিছুদিন খেলে ঐ অসুবিধাটা চলে যায়। তবে এর সঙ্গে পিণ্ড খেজুর (ইরাকী খেজুর) এ-বেলা দু’টো ও-বেলা দুটো করে খেলে আরও ভাল পাওয়া যায়।
৫. কুষ্ঠ ও বাতরক্তে: শোধিত ভেলা দিয়ে প্রস্তুত ঘি প্রত্যহ ৫ থেকে ২ চা-চামচ পত্তি নিয়ে একটু চিনি মিশিয়ে সিকি কাপ দুধের সঙ্গে খেতে হবে। এর দ্বারা বহু ক্ষেত্রে ভাল ফল পাওয়া যায়।
৬. গেঁটেবাতে: যাঁরা গাঁটে গাঁটে ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, তাঁরা যদি উপরিউক্ত হরীতকী মিশ্রিত ভেলা চূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় সিকি কাপ দুধ সহ প্রত্যহ একবার অথবা দু’বার সেবন করেন, তবে ঐ গাঁটের ব্যথার হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন।
ভোলাটুকি-এর অন্যান্য ব্যবহার:
ভেলার তৈল: এর তেল বিষাক্ত। চুলকানিতে সূচের ডগায় লাগিয়ে ব্যবহার করতে হয়। একটি ভেলাকে প্রদীপের আলোতে গরম করলে তা থেকে যে তেল বেরুবে, সেই তেল এক পোয়া দুধের সঙ্গ মিশিয়ে খেলে সর্দিতে আরাম পাওয়া যায়; বালকদের খাওয়ালে সর্দি ও আল-জিহ্বা বৃদ্ধি কমে যায়। প্রস্রাবকারক, বাতনাশক ও কুষ্ঠগ্ন।
বীজের শাঁস বা মজ্জা: পুষ্টিকর, ক্রিমিনাশক ও অগ্নিদ্দীপক। গাছের ছালের আঠা-গ্রন্থিশোথ, মূত্রনালী প্রদাহ, কুষ্ঠের যন্ত্রণা ও স্নায়বিক দৌর্বল্যে ব্যবহার্য ।
গাছের ছাই: অন্য ঔষধের সঙ্গে মিশিয়ে সর্পবিষে ও কাঁকড়া বিছার হুল ফোটানোর যন্ত্রণায় ব্যবহার করা হয়।
ভোলাটুকি-এর বাহ্য বা আভ্যন্তরিক ব্যবহারে কোনরূপ গোলমাল দেখা দিলে শরীরের চামড়া লালবর্ণ হয়, কোন কোন অংশ চুলকোতে থাকে, অশান্তি বোধ হয়, তখনই এর প্রয়োগ বন্ধ করতে হয় এবং প্রয়োজনমত এলার্জি নাশক ঔষধাদি ব্যবহার করা উচিত। ভেলা ঠিকমত শোধিত না হলে, উপযুক্ত মাত্রায় এবং সঠিক নিয়মানুযায়ী ব্যবহৃত না হলে, এই বীজে কারো এলার্জি থাকলে এ ধরনের বিপর্যয় আসাটা স্বাভাবিক।