জাতীয় স্মৃতিসৌধ-National Martyrs Memorial
জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত বেসামরিক বাঙালি ও অবাঙ্গালিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। এটি সাভারে অবস্থিত। এর নকশা প্রণয়ন করেছেন স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের দশটি গণকবর রয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রনায়কগণ সরকারিভাবে বাংলাদেশ সফরে আগমন করলে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রাচারের অন্তর্ভুক্ত।
ইতিহাস
স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের সর্বমোট আয়তন ৮৪ একর। স্মৃতিস্তম্ভ পরিবেষ্টন করে রয়েছে ২৪ একর এলাকাব্যাপী বৃক্ষরাজিশোভিত একটি সবুজ বলয়। স্মৃতিসৌধটির উচ্চতা ১৫০ ফুট। সৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত। বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধটিতে রয়েছে ৭টি ফলক। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি পর্যায়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সাতটি পর্যায়ের প্রথমটি সূচিত হয়েছে ১৯৫২ -র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ - এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসাবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত হয়েছে।
১৯৭১ এর ডিসেম্বরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ,মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয়,তাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ স্মরণ করে স্মৃতি সৌধ সাভারে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয় ।১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে নবীনগরে এই স্মৃতি সৌধের শিলান্যাস করেন। স্থান নির্বাচন,রাস্তা নির্মাণ ও ভূমি উন্নয়নের পর স্থাপত্যের নকশা নির্বাচনের জন্য দেশ জুড়ে শিল্পী,স্থপতি ও ভাস্করদের কাছ থেকে নকশা আহ্বান করা হয় ।১৯৭৮ সালের জুন মাসে নকশা জমা দেওয়ার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ।৫৭টি সেরা নকশার মধ্য থেকে স্থপতি সৈয়দ মইনুল হোসেনের নকশাকে নির্বাচন করা হয়।১৯৮২ সালের কিছু পর স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামো,কৃত্রিম লেক এবং উদ্যান তৈরির কাজ সমাপ্ত হয় ।২০০২ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত প্রকল্প অনুযায়ী এখানে একটি অগ্নিশিখা , ম্যুরাল এবং একটি গ্রন্থাগার স্থাপনের পরিকল্পনা আছে।
জাতীয় স্মৃতি সৌধ নির্মাণের কাজ তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয় ।প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৭২ সালে।সে সময় ২৬ লাখ টাকা খরচ করে ভূমি অধিগ্রহণ ও সড়ক নির্মাণের কাজ করা হয়।দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কাজ চলে।এ সময় ৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা খরচ করে গণকবরের এলাকা,হেলিপ্যাড,গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান,চত্বর ইত্যাদি নির্মিত হয় ।১৯৮২ সালের আগস্ট মাসে শুরু হয় মূল স্মৃতি সৌধ তৈরির কাজ ।৮৪৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় স্মৃতি সৌধ ।এর পর এখানে তৈরি হয় কৃত্রিম লেক,সবুজ বেষ্টনী,ক্যাফেটেরিয়া,রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য আবাসিক এলাকা ইত্যাদি ।
গৌরবময় এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে সিমেন্ট লেগেছে ১ হাজার ৪০০ টন। লোহা ৪৮০ টন। পাথর ১ লাখ ঘনফুট। বালি ৫০ হাজার ঘনফুট এবং কংক্রিটের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ঘনফুট। যারা কাজ করেছেন তাদের মোট শ্রমঘণ্টা লেগেছে ১১,৮৮,০০০ ঘণ্টা।
কীভাবে যাবেন
আগে ঢাকা থেকে স্মৃতিসৌধে সরাসরি যাওয়ার তেমন ভালো কোন পরিবহন ব্যবস্খা ছিল না। কিন্তু এখন যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত রয়েছে। সম্প্রতি চালু হয়েছে বিআরটিসি বাস সার্ভিস। যা মতিঝিল-গুলিস্তান থেকে শাহবাগ, ফার্মগেট, আসাদগেট, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার হয়ে স্মৃতিসৌধে যায়। ভাড়া ২০ টাকা। উল্লেখ্য, প্রিমিয়াম ও বিআরটিসি সার্ভিসের রুট প্ল্যান একই।
পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু আরামে যেতে চাইলে যাওয়া যেতে পারে ট্যাক্সি ক্যাবে। সেক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বেশী পড়বে। সব মিলিয়ে খুব সহজেই ঘুরে আসা যায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে। যেখানে গেলে শুধু প্রকৃতির কাছেই যাওয়া যাবে না তার সাথে নিজের মত করে উপলব্ধি করা যাবে মহান মুক্তিযুদ্ধকে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ কখন খোলা থাকে
সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশের জন্য কোন প্রবেশ মূল্য নেই। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সৌধে বেড়ানো যায়। চাইলেই যে কোনো দিন আপনারা সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
যা কিছু করবেন না
চকলেট আর চিপস খেয়ে প্যাকেটগুলো যেখানে সেখানে ফেলে দেবেন না। বরং পড়ে থাকা ময়লা আবর্জনা তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে পা্রেন।আর গাছ থেকে ভুলেও কখনো ফুল ছিঁড়বেন না।
অনেকেই স্মৃতিসৌধের পাশে থেকে হেটে হেটে সৌধের উপরে উঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনে রাখবে্ন এটা কিন্তু একেবারেই অনুচিত কাজ। কারণ এতে স্মৃতিসৌধের অসম্মান হয় আর স্মৃতিসৌধকে অসম্মান করা মানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অসম্মান।